
ট্রান্সফার উইন্ডো উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোচরা বিপুল বাজেট নিয়ে খেলোয়াড় দলে ভেড়াতে নেমে পড়েন। অনেক সময় তাঁদের এই খরচের খেল বিস্ময় জাগায়। ফুটবলপ্রেমীদের মনে এই প্রশ্নও জাগে, শীর্ষ কোচরা আসলে কত টাকা ব্যয় করেন?
ট্রান্সফারমার্কেটের সহায়তা নিয়ে সেটির উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্লাব ফুটবলের দলবদলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন—এমন ১০ কোচ কারা?
যুগে যুগে লিভারপুলে অনেক কিংবদন্তি কোচ এসেছেন, হয়তো আসবেনও। তবে ইয়ুর্গেন ক্লপ অমর হয়ে থাকবেন। লিভারপুলের বড্ড দুঃসময়ে দায়িত্ব নিয়ে সোনালি সময় ফিরিয়েছেন ক্লপ।
তাঁর কোচিংয়েই প্রিমিয়ার লিগ জমানায় প্রথম শিরোপা জেতে অলরেডরা। চ্যাম্পিয়নস লিগ, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয়সহ ক্লাবটিকে এনে দিয়েছেন প্রায় সব সর্বোচ্চ সাফল্য। লিভারপুলের আগে নিজ দেশ জার্মানির দুই ক্লাব মাইনৎস ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
তিন ক্লাবের প্রধান কোচ হিসেবে ক্লপ ব্যয় করেছেন ১১৫ কোটি ইউরো (১৬ হাজার ২৭০ কোটি ২০ লাখ টাকা)। কিনেছেন ৮৬ জন ফুটবলার। বর্তমানে রেড বুলের বৈশ্বিক ফুটবল প্রধানের দায়িত্বে আছেন ক্লপ।
মাইনৎস, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, পিএসজি, চেলসি এবং সর্বশেষ বায়ার্ন মিউনিখ—এখন পর্যন্ত পাঁচটি ক্লাবের প্রধান কোচের দায়িত্ব সামলেছেন টমাস টুখেল। জার্মান এই কোচ শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব ফুটবলে ১৫ বছর কোচিং করিয়ে কিনেছেন ৭৩ ফুটবলার, ব্যয় করেছেন ১২২ কোটি ইউরো (১৭ হাজার ২৬০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা)।
চ্যাম্পিয়নস লিগসহ জিতেছেন ১১টি ট্রফি। এ বছরের শুরুতে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছেন টুখেল। গত ১৩ বছরের মধ্যে তিনিই ইংল্যান্ডের প্রথম বিদেশি কোচ।
দুই দশকের বেশি সময়ে ৯টি ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন উনাই এমেরি। এখন পর্যন্ত ৯৯ জন খেলোয়াড় কিনতে তিনি খরচ করেছেন ১২৮ কোটি ইউরো (১৮ হাজার ১০৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা)। ক্যারিয়ারে ১১টি ট্রফি জিতেছেন এই স্প্যানিশ।
এর মধ্যে সেভিয়ার হয়ে ইউরোপা লিগের হ্যাটট্রিক শিরোপাও আছে। এমেরির কোচিংয়েই ৪১ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেয় অ্যাস্টন ভিলা। ইংলিশ ক্লাবটি গত মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনালেও উঠেছে।
চিলির পন্টিফিকাল ক্যাথোলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। চাইলেই প্রকৌশলী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু মানুয়েল পেলেগ্রিনি ঝুঁকে পড়েন ফুটবলে। পেশাদার ফুটবলে খেলেছেন মাত্র সাত বছর। কিন্তু কোচিং ক্যারিয়ারটা দীর্ঘ ৩৭ বছরের।
এই সময়ে চিলি, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা, চীন, ইংল্যান্ড ও স্পেনের বিভিন্ন ক্লাবের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। লিগ শিরোপা জিতেছেন চারটি দেশে। অন্য ক্লাব থেকে নিজ দলে খেলোয়াড় এনেছেন ১১১ জন, ব্যয় করেছেন ১২৯ কোটি ইউরো (১৮ হাজার ২৫০ কোটি ৯২ লাখ ইউরো)। বর্তমানে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল বেতিসের দায়িত্বে আছেন পেলেগ্রিনি।
সর্বোচ্চ খরচের তালিকায় ছয়ে আছেন আন্তোনিও কন্তে। ‘খ্যাপাটে কোচ’ হিসেবে পরিচিত কন্তে ১০৫ খেলোয়াড়কে কিনতে ব্যয় করেছেন ১৩৬ কোটি ইউরো (১৯ হাজার ২৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকা)। তাঁর অধীনেই সর্বশেষ মৌসুমে সিরি ‘আ’–তে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নাপোলি।
টটেনহাম, ইন্টার মিলান, চেলসি, জুভেন্টাস, আতালান্তার মতো ক্লাবেরও প্রধান কোচ ছিলেন কন্তে। তবে বাকিদের চেয়ে কমই সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে তিনি ট্রফি জিতেছেন ৯টি।
ইতালিয়ান ফুটবলে বেশ পরিচিত মুখ মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি। পুরো কোচিং ক্যারিয়ারই যে তাঁর ইতালিতে কেটেছে। জুভেন্টাসের সাবেক এই কোচকে সম্প্রতি আবারও দায়িত্বে এনেছে এসি মিলান।
আলেগ্রি এখন পর্যন্ত কিনেছেন ১২০ জন ফুটবলার। তাঁদের পেতে ব্যয় করেছেন ১৪৮ কোটি ইউরো (২০ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪ লাখ টাকা)। দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ারে তিনি ট্রফি জিতেছেন ১৪টি।
আতলেতিকো মাদ্রিদ আর দিয়েগো সিমিওনে যেন সমার্থক। তবে ২০১১ সালে স্প্যানিশ ক্লাবটির দায়িত্ব নেওয়ার আগে আরও ছয় ক্লাবের প্রধান কোচ ছিলেন সিমিওনে। শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব ফুটবলে প্রায় দুই দশকের কোচিং ক্যারিয়ারে ৯৮ খেলোয়াড় কিনেছেন এই আর্জেন্টাইন, খরচ করেছেন ১৫২ কোটি ইউরো (২১ হাজার ৫০৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা)।
কোচ হিসেবে এখন পর্যন্ত ১০টি ট্রফি জিতেছেন সিমিওনে। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে ক্লাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এক ক্লাবের দায়িত্বে থাকা কোচদের তালিকায় দুইয়ে আছেন তিনি।
কোচদের ডন বলা হয় কার্লো আনচেলত্তিকে। শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে আনচেলত্তি কোচিং করাচ্ছেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। ব্রাজিল জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ১০টি ক্লাবের ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন এই ইতালিয়ান, জিতেছেন ৩০টি ট্রফি।
এত সাফল্যের পেছনে অঢেল অর্থেরও ভূমিকা আছে। ক্লাবের কোচ হিসেবে ১২৬ খেলোয়াড়কে দলে ভিড়িয়েছেন, এ জন্য খরচ করেছেন তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৮৩ কোটি ইউরো (২৫ হাজার ৮৯০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা)।
ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের শিরোপাজয়ী একমাত্র কোচ তিনি। কোচ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পাঁচবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের রেকর্ডটাও তাঁর।
বেনফিকা, ইউনিয়াও দে লেইরিয়া, এফসি পোর্তো, চেলসি, ইন্টার মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, টটেনহাম হটস্পার, এএস রোমা ও ফেনেরবাচে—এখন পর্যন্ত ১০টি ক্লাবের প্রধান কোচ হিসেবে দেখা গেছে জোসে মরিনিওকে।
শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব ফুটবলে ‘স্পেশাল ওয়ান’–খ্যাত এই কোচের ক্যারিয়ার বেশ লম্বা—২৫ বছর। এ সময়ে তিনি নিজের ক্লাবে এনেছেন ১৯৭ জন ফুটবলার, তাঁদের মধ্যে কিনেছেন ১৩১ জনকে। তাঁদের পেছনে এই পর্তুগিজ মোট ব্যয় করেছেন ১৯৬ কোটি ইউরো (২৭ হাজার ৭৩০ কোটি ৮ লাখ টাকা)।
মরিনিওর সাফল্যও কম নয়; জিতেছেন ২৬টি শিরোপা। একমাত্র কোচ হিসেবে উয়েফা আয়োজিত তিনটি ক্লাব প্রতিযোগিতারই (চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগ, কনফারেন্স লিগ) শিরোপা জিতেছেন তিনি।
দলবদলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি খরচ করা কোচ পেপ গার্দিওলা। তরুণ গোলকিপার জেমস ট্রাফোর্ডকে দুই মৌসুম পর বার্নলি থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে ফিরিয়েছেন গার্দিওলা। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোচ হিসেবে খেলোয়াড় কিনতে ২ বিলিয়ন ইউরো খরচের রেকর্ড গড়েছেন এই স্প্যানিশ।
শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব ফুটবলে ১৭ বছর ধরে কোচিং করাচ্ছেন গার্দিওলা। ম্যানচেস্টার সিটির আগে ছিলেন বায়ার্ন মিউনিখ ও বার্সেলোনার প্রধান কোচ। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ১১১ জন খেলোয়াড়কে নিজের দলে এনেছেন। তাঁদের মধ্যে ৯৫ জনকে কিনতে হয়েছে (বাকি ১৬ জন ছিলেন ফ্রি এজেন্ট)।
সেই ৯৫ জনের পেছনে তিনি ব্যয় করেছেন ২৪৮ কোটি ইউরো (৩৫ হাজার ৮৭ কোটি ৪ লাখ টাকা), সাফল্যও পেয়েছেন অনেক। এখন পর্যন্ত জিতেছেন ৩৯টি ট্রফি। দুটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ট্রেবল জেতা প্রথম কোচ তিনিই।