Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবন

বাফুফের কেনাকাটায় যেসব জালিয়াতি ধরেছে ফিফা

আর্থিক জালিয়াতির দায়ে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছর নিষিদ্ধ ও ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা করার আগে দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানি কার্যক্রম চালিয়েছে ফিফা। মোট ৪টি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে ধারা ১৫ (সাধারণ কর্তব্য), ধারা ১৩ (আনুগত্যের দায়িত্ব), ধারা ২৪ (জালিয়াতি ও মিথ্যাচার) ও ধারা ২৮ (তহবিল তছরুপ ও অপব্যবহার)।

এর মধ্যে প্রথম তিনটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিফার স্বাধীন এথিকস কমিটির বিচারিক চেম্বার। কেনাকাটা ও ফিফার তহবিল অপব্যবহার নিয়ে আবু নাঈম সোহাগকে পাঠানো ৫১ পৃষ্ঠার চিঠিটি ফিফার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। যে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বাফুফে ও এএফসিকে।

যেসব অনিয়মের জন্য সোহাগের এই শাস্তি, সব কটি ঘটনা ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে। যেটির তদন্ত শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। গত বছর অক্টোবরে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ফিফার সদর দপ্তরে শুনানি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। যেখানে সোহাগ ও তাঁর পক্ষে চারজন আইনজীবী অংশ নেন।

Also Read: বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফিফা

বাফুফেকে দেওয়া ফিফার তহবিলের ব্যবহার নিয়েও বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়েছে ফিফার তদন্তে। কেনাকাটায় চারটি অনিয়মের কথা বিস্তারিত উল্লেখ করেছে ফিফা। এখানে থাকল শুধু সেই অংশটাই—

ক্রীড়া পরিধেয় সামগ্রী কেনা

২০২০ সালের জুনে আবাসিক ক্যাম্প ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাচের জন্য কিছু ক্রীড়া পরিধেয় সামগ্রী ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বাফুফের ন্যাশনাল টিমস কমিটি। এই কেনাকাটায় দরপত্র জমা দেয় স্পোর্টস লিংক, স্পোর্টস কর্নার ও রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। বিডিংয়ে মালামাল সরবরাহের কাজ পায় স্পোর্টস লিংক। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৩০ হাজার ২৭ ডলার (প্রায় ৩২ লাখ টাকা) মূল্যের পণ্য সরবরাহের কার্যাদেশ দেন সোহাগ।

কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপের তদন্তে উঠে আসে, যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বিড করেছিল, সব কটিই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। তিন বিডেই ‘কোটেশন’ শব্দটি ‘Qutations’ বানানে লেখা। কোনোটিতেই প্রতিষ্ঠানের সিল নেই। দুটি বিডের বক্তব্য শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, ‘...পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে।’ যদিও তাদের কোনো অর্ডারই দেওয়া হয়নি।

Also Read: বাফুফে সাধারণ সম্পাদক নিষিদ্ধ, সালাউদ্দিন বললেন, ‘ভেরি স্যাড’

২০২১ সালের ৫ মার্চ ফিফার নিয়োগ করা বিডিও এলএলপির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি দরপত্রের ডিজাইন একই রকম। রবিন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটি ভুয়া। স্পোর্টস কর্নার আর স্পোর্টস লিংক পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত। আবার স্পোর্টস লিংকের মালিক রবিনই সম্ভবত স্পোর্টস কর্নারের সাবেক মালিক। এ ছাড়া দরপত্র প্রস্তাব ও সরবরাহ নিশ্চিতের সময়েও ধারাবাহিকতা নেই।

যা থেকে ফিফার কমিটি সিদ্ধান্তে আসে যে তিনটি দরপত্রের উৎসই এক—তিনটি আলাদা কোম্পানির নয়।

ফুটবল কেনা

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৯২১ ডলার (প্রায় ১৫ লাখ টাকা) দামে ৪০০টি ফুটবল কেনে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এখানেও দরপ্রস্তাব দিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান—মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়াস ক্লোজেট। দরপ্রস্তাবে জেতে ওফেলিয়াস।

সোহাগের সরবরাহ করা কাগজে লেখা আছে, ‘ফিফা অনুমোদিত বাফুফের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯–২০ মৌসুমের ম্যাচ পরিচালনার জন্য এই কেনাকাটা জরুরি।’ ব্যাখ্যায় বলা হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রীড়াপণ্য সরবরাহ করে থাকে।  

আবু নাঈম সোহাগ

কন্ট্রোল রিস্কের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ওফেলিয়াস ক্লোজেটের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে তাদের অস্তিত্ব নেই। তারা নারীদের পোশাক বানায়। বাফুফেকে ফুটবল সরবরাহের প্রতিষ্ঠান নয় এটি। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের দরপ্রস্তাবে তাদের খুঁজে পাওয়ার মতো তথ্য নেই। কোনো সিল নেই দরপ্রস্তাবে।

নিরীক্ষায় উঠে আসে, ওফেলিয়াসের ফুটবল সরবরাহের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাদের কোনো আমদানি সনদও নেই। তবে এক বন্ধুর সনদ ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন সরবরাহকারী। প্রতিষ্ঠানটিকে চালান ছাড়াই অর্থ পরিশোধ করে বাফুফে।
প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, এটি স্পষ্ট যে সব কটি দরপ্রস্তাবই বানানো। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের স্বাক্ষরসহ যে দরপত্র দেওয়া হয়েছে, সেটিও মূল কাগজ নয়, ফটোকপি।  

Also Read: বাফুফের টাকা খরচ ও লেনদেন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ফিফার

বিমানের টিকিট

২০১৯ সালের নভেম্বরে ফ্লাইট টিকিট বাবদ আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার (প্রায় সোয়া ২১ লাখ টাকা) দেয় বাফুফে। খাত হিসেবে দেখানো হয় জাতীয় দলের ওমান সফর। এ ক্ষেত্রে দরপ্রস্তাব দেয় আর মারওয়া, পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস।

তিনটি দরপ্রস্তাবই শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, যেখানে রুট শব্দটি একই বানানে লেখা ‘rout’। সব কটিতে সংখ্যার ভুল একই রকম (১, ৩, ৪), একই তারিখে জমা দেওয়া এবং দেখতে একই রকম। পূরবী জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমানের টিকিট কেনায় দরপ্রস্তাব দেওয়ার কথা নয় বলে উল্লেখ করে কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ। পূরবী ও মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, তারা দরপ্রস্তাব দেয়নি। বাফুফের সঙ্গে কোনো কাজও করেনি।

ঘাস কাটার যন্ত্র

২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৪১২ মার্কিন ডলারে (প্রায় দেড় লাখ টাকা) ঘাস কাটার যন্ত্র কেনে বাফুফে। দুটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়। একটি বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার, আরেকটি শোভা এন্টারপ্রাইজ। কাজটা পায় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর সোহাগ কার্যাদেশ দেওয়ার দুই দিন পর শারমিন এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়।

এখানে পাওয়া অনিয়মের মধ্যে আছে বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার প্রতিষ্ঠানের নামের বানানে ভুল। শোভা এন্টারপ্রাইজ আর শারমিন এন্টারপ্রাইজের দরপ্রস্তাব দেখতে এক রকম। শারমিন এন্টারপ্রাইজে যোগাযোগ করলে তারা নিজেদের শোভা এন্টারপ্রাইজ হিসেবে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
এ বিষয়ে উপসংহার হচ্ছে, সব দরপত্রই একই জায়গা থেকে করা হয়েছে।

তদন্তের শুরু যেভাবে

শুরুটা ২০২০ সালের অক্টোবরে। ফিফার কমপ্লায়েন্স সাবডিভিশন স্বাধীন এথিকস কমিটির ইনভেস্টিগেটরি চেম্বারকে জানায়, বহির্নিরীক্ষা পরামর্শক কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ বাফুফের কেনাকাটার বিডিং প্রক্রিয়ায় কিছু অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। কমপ্লায়েন্স ডিভিশনের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বিডিও এলএলপিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। বিডিও ২০২১ সালের ৫ মার্চ একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

এই প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাফুফের কেনাকাটা ও তহবিল ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো বিস্তারিত উঠে আসে।  
প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফিফার ইনভেস্টিগেটরি চেম্বারের চেয়ারপারসন মার্টিন এনগোগা ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল নিশ্চিত হন যে সোহাগের বিরুদ্ধে ফিফা কোড অব এথিকস লঙ্ঘনের প্রাথমিক আলামত পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে সম্ভাব্য ৪টি ধারা লঙ্ঘনের আনুষ্ঠানিক তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু করে এথিকস কমিটি।

এ বিষয়ে ২০২১ সালের ২২ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সোহাগ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করে ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার। তাদের অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান লিখিতভাবে জানাতে অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি বাফুফেকে দেওয়া ফিফা তহবিলের কয়েকটি সমস্যাযুক্ত লেনদেনের বিষয়ে যুক্তি ও সঠিক অঙ্কের বিষয়টি পরিষ্কার করতে বলা হয়।

২০২২ সালের ১৭ জুন ইনভেস্টিগেটরি চেম্বারের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন সোহাগ। একই বছরের ২৬ অক্টোবরে তদন্ত কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার অ্যাজুডিকেটরি চেম্বারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

সোহাগই কেন নিষিদ্ধ

যেসব অনিয়মের ঘটনা তদন্তে উঠে এসেছে, সব কটিতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন আবু নাঈম সোহাগ। ফিফার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাফুফে সচিবালয়ের পরিচালক হিসেবে ফেডারেশনের প্রশাসনিক কার্যক্রমের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের কাঁধে বর্তায়। বাফুফে গঠনতন্ত্রের ৫৯ ধারায়ও লেখা আছেে, ফেডারেশনের হিসাব ব্যবস্থাপনা ও ফিফার যোগাযোগের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের।

ফিফার বিচারিক চেম্বারের মতে, প্রতিটি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সোহাগ। দরপ্রস্তাব অনুমোদন এবং কার্যাদেশও দিয়েছেন তিনি।

ফিফা নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং ফিফা তহবিল ব্যয়ের ব্যবস্থাপনায় মিথ্যা কাগজপত্র তিনি ব্যবহার এড়াতে পারতেন। এ জায়গায় সোহাগের গাফিলতি ও অনিয়মের দায় পাওয়া গেছে।