বুয়েনস এইরেস থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে পারানা নদী। ব্রাজিলের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনার ভেতর দিয়ে গড়িয়ে পারানা মিশেছে রিও দি লা প্লাতায়। মিশেছে মেসির হৃদয়েও।
জন্মের পর থেকেই পারানা নদীর সঙ্গে যেন মেসির একাত্মতা, এই নদীর বুক চিড়েই যেন তাঁর আবির্ভাব। পারানার তীরবর্তী শহর রোজারিওতে তাঁর জন্ম। এই নদীর শান্ত জল চিরে জাহাজের চলাচল দেখে কেটেছে তাঁর শৈশব। গত বছর এই পারানাকে রক্ষার উদ্যোগে সরাসরি যুক্ত হয়ে নদীর প্রতি ভালোবাসাকে আরও স্পষ্ট করেছেন মেসি। তবে তাঁর সঙ্গে পারানার যোগাযোগ শুধু ভৌগোলিক নয়, মেসির মনোজাগতিক অন্তরঙ্গতার যে মোহনা, সেখানেও মিশেছে পারানা।
আজ বাংলাদেশ সময় ভোরে মেসি যখন বুয়েনস এইরেসের এস্তাদিও মনুমেন্তালে জাতীয় দলের হয়ে দেশের মাটিতে নিজের শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলছিলেন, পারানার বুকে তখন কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। শান্ত, নিস্তরঙ্গ ধারায় বয়ে গেছে স্রোত। ওদিকে মাঠে মেসি যথারীতি স্বভাবসুলভ জাদুকরি ভঙ্গিতে।
ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে তাঁর জোড়া গোলে উত্তাল মনুমেন্তাল। কে জানে, ইতিহাসের অন্যতম সেরা কিংবা তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলারকে নিয়ে পারানার বুকও তখন হয়তো আরেকটু প্রশস্ত হয়েছিল! যদিও আবহাওয়ার অনুমতি ছাড়া নদীর বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখানোর নিয়ম নেই, কিন্তু কল্পনা তো করাই যায়!
নদী, পাহাড়, সমুদ্র কিংবা বনজঙ্গলের প্রভাব ব্যক্তি মানুষের জীবনে স্পষ্ট। শৈশবে মানুষের বেড়ে ওঠায় প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ সরাসরি ভূমিকা রাখে। গভীরভাবে ভাবলে মেসির জীবনেও পারানার প্রভাব তেমনই।
দেশের মাটিতে শেষ ধরে নিয়েই তো স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন মাঠে। জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে ভিজে উঠছিল চোখ। মাঠে সন্তানদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেই ভেজা ভেজা মুহূর্তে চোখে বাঁধ দিয়ে আড়াল করতে চাইলেন বেদনাবোধ।
নদী প্রকৃতিগতভাবে শান্ত স্বভাবের। এমনকি প্রবল প্রমত্ত নদীরও থাকে একটি গভীর শান্ত রূপ। নিজের সেই শান্ত প্রতিরূপ নিয়েই বছরের পর বছর ধরে সে চালিয়ে যায় নিজের লড়াই। প্রতিনিয়ত বয়ে যাওয়ার এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখার এই বৈশিষ্ট্যই নদীকে প্রবল এক ‘শক্তি’তে রূপান্তরিত করে।
এমনকি পৌরাণিক গল্পেও নদীকে দেব–দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আর নদীর সেই দেবত্বই যেন নিজের মধ্যে ধারণ করে মেসি হয়ে উঠেছেন তর্কযোগ্যভাবে ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ কিংবা এমন এক ‘নদী’ যাঁর কোনো তল নেই!
পারানার গতিপ্রকৃতির বেশ জটিল। এটি পৃথিবীর দশম এবং দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী (প্রায় ৪,৮০০ কিলোমিটার), অ্যামাজনের পরেই এর স্থান। দীর্ঘ পথের ভ্রমণে এই নদীকে অতিক্রম করতে হয় জটিল সব পথ। ফলে এর প্রবাহ কখনো শান্ত, আবার কখনো প্রবল। ঠিক যেন মেসির জীবনের মতোই। পারানার মতো জটিল ও কঠিন পথ পেরিয়েই মেসি আজ কিংবদন্তি।
মেসির জীবনের গল্পটা এখন অতিকথনে একদমই ক্লিশে। তবু বলতে হয়, হয়তো সামনে আরও বলা হবে—যেভাবে এই পৃথিবীতে কিংবদন্তিদের গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকে। সেই যে রোজারিওতে শুরু, বাথরুমে আটকে পড়ার পর জানালা ভেঙে মাঠে নেমে দলকে জিতিয়ে সাইকেল উপহার পাওয়া, হরমোনজনিত সমস্যা, বার্সেলোনা যাত্রা এবং ন্যাপকিন পেপারে সই করে কাতালান ক্লাবটিতে যোগ দেওয়া—মেসির উঠে আসার পুরো পথটাই ছিল জটিল ও নাটকীয়তায় ভরপুর।
এমনকি মাঝে একবার তো ব্যর্থতা ও হতাশায় জাতীয় দলকে বিদায়ও বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু নদীকে যেমন কোনো বাধাই আটকে রাখতে পারে না, মেসিকেও পারা যায়নি। ফিরে এসে মেসি যেন পারানারই প্রমত্ত রূপ। কিন্তু সেটা ভেতরে–ভেতরে, কারণ লক্ষ্য ছিল একটাই—বিশ্বকাপ শিরোপা। যে ট্রফি খণ্ডন করবে আর্জেন্টাইন ফুটবলে তাঁর ‘দেবতা’ হয়ে উঠেও ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া ‘অভিশাপ’—মনে আছে, মেসিকে নিয়ে একসময় এমন কথা ছিল বহুল চর্চিত; শুধু ক্লাবের ফুটবলেই পারেন, জাতীয় দলে সাফল্যের ঝুড়ি শূন্য!
পারানা যেভাবে লা প্লাতায় গিয়ে মিশেছে, তেমনি বিশ্বকাপ ট্রফিই ছিল মেসির শেষ মিলনস্থল। ২০২২ বিশ্বকাপেই সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। বিশ্বকাপ ট্রফিতে মিশে মেসি হয়েছেন চিরন্তন। এরপর তো আর কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই, শুধুই বয়ে যাওয়া। কিন্তু মানবজীবনে সেই বয়ে যাওয়ারও তো শেষ আছে। ধাপে ধাপে শেষ হয় বৃত্ত পূরণের গল্প। পারানাকে সাক্ষী রেখেই আজ শেষ হলো মেসির তেমন একটি অধ্যায়। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর একটি—আর্জেন্টিনার মাটিতে দেশের মানুষের সামনে শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেললেন মেসি।
আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন (এএফএ) এরপর তাদের এই ফুটবল–দেবতাকে বিদায় জানাতে হয়তো দেশের মাটিতে প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করতে পারে। তেমন একটা গুঞ্জনও উঠেছে আর্জেন্টাইন ফুটবলে। সেটা হোক, না হোক, মেসি আজ যে সত্যের ভেতর দিয়ে গেলেন, সেটা কি তাঁর অজানা ছিল?
দেশের মাটিতে শেষ ধরে নিয়েই তো স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন মাঠে। জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে ভিজে উঠছিল চোখ। মাঠে সন্তানদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেই ভেজা ভেজা মুহূর্তে চোখে বাঁধ দিয়ে আড়াল করতে চাইলেন বেদনাবোধ। গ্যালারিতে তখন কৃতজ্ঞতার স্রোত। ৬০ হাজারের বেশি মানুষে ঠাসা গ্যালারিতে রব উঠেছে, ‘গ্র্যাসিয়াস পোরতোদো মি ক্যাপ্টেন’—সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ আমার অধিনায়ক।
ব্যানারেও অনেকে লিখেও এনেছিলেন এই কথা। মেসির কি তা চোখে পড়েছে? দেখার পর কি চোখ পুড়েছে? আচ্ছা, তাঁর জন্মভূমি এই আর্জেন্টিনাই তো সেই দেশ, যেখানে মেসিকে ‘বাতিল’ ঘোষণা করা হয়েছিল। শুধু আর্জেন্টিনা কেন, পৃথিবীর আরও অন্যান্য দেশের কত ভক্ত বলেছেন, ‘মেসি শুধুই বার্সেলোনার।’
সেই কলঙ্ক মেসির পথচলাকে করে তুলেছিল আরও কঠিন। কিন্তু মেসি যেন পারানা নদীর পাড়ে পড়ে থাকা কোনো ঝিনুক। ভেতরে ঠিকই বিষের বালি নিয়ে মুখ বুঁজে মুক্তা ফলিয়ে গেছেন। আর মুঠো মুঠো ভালোবাসা পাচ্ছেন তার প্রতিদানে। মেসি হয়তো একদিন পাড়ে বসে ভালোবাসার সেই গল্পটাই শোনাবেন পারানাকে।