লোকটাকে সবাই ‘এল লোকো’ বলে ডাকে। বাংলায় যার মানে ‘পাগল’। আর্জেন্টিনায় অবশ্য নামটা অপমানজনক বা বিরল কিছু না। বলা হয়ে থাকে, সে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই বাকি অর্ধেককে ‘এল লোকো’ বলে ডাকে। তবে মার্সেলো বিয়েলসার ক্ষেত্রে এই নামটা কতটা যথার্থ, সেটার প্রমাণ পাওয়া যাবে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, কার্লোস তেভেজ, হাভিয়ের মাচেরানো, হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন ও অ্যান্ডার হেরেরার মতো তাঁর অনেক বিখ্যাত শিষ্যদের গল্পগুলো শুনলে। পেপ গার্দিওলা, মরিসিও পচেত্তিনো ও ডিয়েগো সিমিওনের মতো বিখ্যাত ফুটবল কোচদের আদর্শিক গুরু তিনি এবং মনে করা হয়, ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম উদ্ভট চরিত্র ও প্রহেলিকার নাম বিয়েলসা। আর্জেন্টাইন এই ফুটবল কোচের পাগলামির অনেক বিখ্যাত গল্প আছে, যেগুলোর সন্ধান পাওয়া যাবে ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক টিম রিচের লেখা ‘দ্য কোয়ালিটি অব ম্যাডনেস: আ লাইফ অব মার্সেলো বিয়েলসা’ বইয়ে। কীভাবে বিয়েলসা কিশোর পচেত্তিনোকে খুঁজে বের করেছিলেন এবং তাঁকে নিউয়েলস ওল্ড বয়েজে নিয়ে গিয়েছিলেন, পাঠকদের আজ বলা হবে সেই গল্পটা, যা আছে ‘দ্য কোয়ালিটি অব ম্যাডনেস: আ লাইফ অব মার্সেলো বিয়েলসা’ বইয়ের ‘দ্য রোড টু মারফি’ নামের অধ্যায়ে—
১৯৮৭ সাল, শীতকালের মাঝামাঝি। ঘড়িতে রাত একটা।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তায় পথ হারানো একটা সাদা ফিয়াট ১৪৭ গাড়ি হঠাৎ একটা সার্ভিস স্টেশন খুঁজে পেয়ে থামল। কাউকে পথের দিশা জিজ্ঞেস করতে গাড়ি থেকে দুজন লোক বেরিয়ে এলেন। তাঁরা যাবেন মারফি নামের একটা ছোট শহরে, এক কিশোরের খোঁজে। যে কিশোরের এ সময় অবশ্যই ঘুমিয়ে থাকার কথা।
মরিসিও পচেত্তিনিও নামে সেই কিশোরের স্কুলে যাওয়ার জন্য ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। স্কুলে সে কৃষিবিজ্ঞান পড়ে। সার্ভিস স্টেশন থেকে পথের দিশা নিয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলেন দুই যাত্রী—মার্সেলো বিয়েলসা ও হোর্হে গ্রিফা।
দুজন মিলে একটা বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। যে প্রকল্প একসময় গিয়ে নিউয়েলস ওল্ড বয়েজকে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন ক্লাব বানাবে।
রোজারিও শহরেরই আরেক ক্লাব রোজারিও সেন্ট্রালের মতো নিউয়েলস ওল্ড বয়েজেরও টাকাপয়সা খুব একটা নেই, যেটা আছে বুয়েনস এইরেসভিত্তিক আর্জেন্টিনার বড় ক্লাবগুলোর। বিয়েলসা (সেই সময় নিউয়েলসের বয়সভিত্তিক দলের কোচ) এবং গ্রিফা (ক্লাবের ফুটবল পরিচালক) বুঝতে পারলেন, তাদের টিকে থাকতে হলে আগে বয়সভিত্তিক দল নিয়ে কাজ করতে হবে এবং সেখান থেকে খেলোয়াড় তুলে আনতে হবে।
বিয়েলসা পুরো আর্জেন্টিনাকে ৫০ বর্গমাইলের অনেকগুলো জোনে ভাগ করলেন এবং প্রতিটি জোনে বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করলেন। সেই টুর্নামেন্ট থেকে সেরা খেলোয়াড়দের বেছে চূড়ান্ত ট্রায়ালের জন্য নেওয়া হলো রোজারিওতে।
ওই সন্ধ্যায় আসলে তাঁরা দুজন (বিয়েলসা ও গ্রিফা) একটা আঞ্চলিক ট্রায়াল দেখতে গিয়েছিলেন, রোজারিও থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেকের দূরের শহর ভিয়া কানাসে। ট্রায়াল শেষ করে দুজন স্থানীয় ফুটবল কোচদের সঙ্গে ডিনার করছিলেন। সেখানেই গল্প করতে করতে বিয়েলসা কোচদের জিজ্ঞেস করলেন, ওদের এলাকায় এমন কোনো ছেলে কি আছে, যাকে ট্রায়ালে দেখা হয়নি। একজন কোচ পচেত্তিনো নামে একটা ছেলের কথা বললেন। বিয়েলসা খাওয়ার মাঝেই বললেন, ‘আমি ছেলেটাকে এখনই দেখতে চাই।’ তারপর গাড়িতে করে সোজা মারফি।
বিয়েলসা ও গ্রিফা পচেত্তিনোর বাড়ি খুঁজে বের করলেন। দরজার কড়া নাড়লেন। দরজা খুললেন পচেত্তিনোর মা। দুজন অপরিচিত লোক দেখে তিনি তাঁর স্বামীকে ডাকলেন কথা বলার জন্য। দোতলা থেকে নিচে নেমে এলেন পচেত্তিনোর বাবা হেক্টর।
‘দ্য কোয়ালিটি অব ম্যাডনেস: আ লাইফ অব মার্সেলো বিয়েলসা’ বইয়ে এর পরের ঘটনাটা বলা হয়েছে পচেত্তিনোর জবানিতে, যেটা আসলে পচেত্তিনো লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনী ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এ। চলুন পড়া যাক, এই ঘটনা নিয়ে কী লিখেছেন পচেত্তিনো…
তারা (বিয়েলসা ও গ্রিফা) মারফির সার্ভিস স্টেশনে পৌঁছালেন এবং রাতের সেই সময়ে আশপাশে থাকা অল্প কয়েকজন পথচারীকে জিজ্ঞাসা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমার বাড়িটা খুঁজে পেলেন।
দরজায় টোকা শুনে আমার মা ঘুম থেকে উঠলেন। তাঁরা দুজন নিজেদের পরিচয় দিলেন, কিন্তু মা এত রাতে দরজা খুলতে চাইলেন না। তিনি আমার বাবাকে ঘুম থেকে জাগালেন, বাবা এসে দুজনের পরিচয় পেয়ে দরজা খুলে দুজনকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানালেন।
পরে বিয়েলসা আমাকে বলেছিলেন, পাঁচ বা দশ মিনিট গল্প করার পর এবং তারা কেন সেখানে এসেছেন তা ব্যাখ্যা করার পর দুজন আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন বিয়েলসা আমার বাবাকে বললেন, ‘আমরা কি ছেলেটিকে দেখতে পারি?’
এমন ভোররাতেও আমার গর্বিত বাবা-মা ‘হ্যাঁ’ বললেন এবং তাঁরা আমার শোবার ঘরে আমাকে দেখতে এলেন। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম।
হঠাৎ গ্রিফা বললেন, ‘আমরা কি ওর পা গুলো দেখতে পারি?’ মা আমার ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিলেন এবং তারা দুজনেই বললেন, ‘ওর পা গুলো দেখুন, এগুলো ফুটবলারের পা।’
আমার ছোট শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে কিছু লোক মুগ্ধ হয়ে আমার পা দেখছে, আর আমি তখন গভীর ঘুমে। এসবের কিছুই আমি টের পাইনি। পরের দিন সকালে বাবা আমাকে ঘটনাটি বলার আগপর্যন্ত আমি এর কিছুই জানতাম না।
ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোচদের একজন মনে করা হয় মার্সেলো বিয়েলসাকে। ট্রফির বিচারে সাফল্য তাঁর খুব বেশি নয়, নিউয়েলসকে দুবার আর্জেন্টাইন প্রিমেরা লিগের শিরোপা জিতিয়েছেন, আর্জেন্টিনাকে একবার জিতিয়েছেন অলিম্পিক সোনা (২০০৪), লিডস ইউনাইটেডকে ২০১৯-২০ মৌসুমে ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়নশিপ জিতিয়ে প্রিমিয়ার লিগে তুলেছেন, এইটুকুই। তবে বিয়েলসা বিখ্যাত তাঁর ফুটবল দর্শনের কারণে। পেপ গার্দিওলা, মরিসিও পচেত্তিনো ও ডিয়েগো সিমিওনের মতো বিখ্যাত ফুটবল কোচদের তাত্ত্বিক গুরু তিনি। সে জন্য তাঁকে বলা হয় কোচদের কোচ। এখন কাজ করছেন উরুগুয়ের কোচ হিসেবে। পচেত্তিনো তাঁর দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ারে এসপানিওল, সাউদাম্পটন, টটেনহাম, পিএসজি, চেলসির কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মেসি, কিলিয়ান এমবাপ্পে, নেইমার, হ্যারি কেইনের মতো বিখ্যাত খেলোয়াড়েরা বিভিন্ন সময় তাঁর অধীনে খেলেছেন। এর আগে খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৮৭ সালে ১৫ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে নিউয়েলসের বয়সভিত্তিক দলে যোগ দেওয়া পচেত্তিনোর ক্লাবের মূল দলে অভিষেক হয় ১৯৮৯ সালে। পাঁচ বছর ওল্ড বয়েজে খেলেছেন পচেত্তিনো, বিয়েলসার অধীনে দুবার জিতেছেন আর্জেন্টাইন প্রিমেরা লিগের শিরোপা, একবার খেলেছেন কোপা লিবার্তাদোরেসের ফাইনালও। কিছুদিনের জন্য ওই ক্লাবেই সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের একজনকে, ছিলেন তাঁর রুমমেটও। সেই বিখ্যাত সতীর্থের নাম ডিয়েগো ম্যারাডোনা!