পিএসজিকে হারিয়ে ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে চেলসি। ইংলিশ ক্লাবটির শিরোপা জেতার পেছনে প্রতিপক্ষের অতি-আত্মবিশ্বাস এবং কৌশলে পিছিয়ে থাকাসহ রয়েছে বেশ কিছু কারণ।
‘খুব সাবধানে, চেলসি সব সময় চেলসি’—ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে এই কথা বলে পিএসজিকে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো নাজারিও। ফাইনালে এর আগেও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিজেদের হুমকি হিসেবে প্রমাণ করেছিল ‘ব্লুজ’রা। ২০১১-১২ মৌসুমে ফেবারিট বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল তারা। আর ২০২০-২১ মৌসুমে চেলসির হাতে কুপোকাত হয়েছিল তখনকার অন্যতম সেরা দল ম্যানচেস্টার সিটি।
ফলে সময়ের সেরা ছন্দে থাকলেও চেলসির সামনে পিএসজি পথ হারানোর শঙ্কাটা সব সময়ই ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কা সত্যিও হয়েছে। ফাইনালে ইংলিশ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে রীতিমতো উড়ে গেছে ফরাসি ক্লাবটি। ফেবারিট হিসেবে ফাইনালে এসে পিএসজির ধরাশায়ী হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। সেই কারণগুলোর মধ্যে ৫টি এখানে তুলে ধরা হলো।
ফাইনালের সূচি ঠিক হওয়ার পর থেকেই অনেকে পিএসজিকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলেন। এর পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণও ছিল। পিএসজি এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে নিজেদের সেরা ছন্দে আছে। চ্যাম্পিয়নস লিগসহ ট্রেবল জিতেই ক্লাব বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছিল তারা। প্রতিযোগিতার ফাইনাল নিশ্চিত করার পথে আতলেতিকো মাদ্রিদ, ইন্টার মায়ামি, বায়ার্ন মিউনিখ এবং রিয়াল মাদ্রিদকে উড়িয়ে দিয়েছে তারা।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স এবং ছন্দের দিক থেকে পিএসজির ধারেকাছেও ছিল না চেলসি। দুই দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানই হয়তো পিএসজিকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল এবং তারা মাঠে নামার আগেই নিজেদের চ্যাম্পিয়নস ধরে নিয়েছিল। আর এ কারণেই হয়তো ফাইনালের মতো ম্যাচে যে শরীরীভাষায় ও আগ্রাসী মেজাজে পিএসজির খেলার কথা ছিল, সেটা দেখা যায়নি। যা শেষ পর্যন্ত পিএসজিকে পিছিয়ে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পিএসজির আক্রমণভাগকে দেখা গেছে অপ্রতিরোধ্য ছন্দে। বড় ম্যাচগুলোতে তাদের করা গোলের সংখ্যা দেখলেই চিত্রটা স্পষ্ট হওয়া যাবে। সেমিফাইনালের কথাই ধরা যাক। সেদিন রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দেয় পিএসজি। এর আগে ইন্টার মায়ামি ও আতলেতিকো মাদ্রিদের জালে ৪ বার করে বল জড়ায় তারা। অথচ সেই আক্রমণভাগ ফাইনালে একেবারেই নিষ্প্রভ ছিল। দলের অন্যতম সেরা তারকা উসমান দেম্বেলে যেমন পুরো ৯০ মিনিট মাঠে থেকে মাত্র ১টি শট নিতে পেরেছেন।
একইভাবে ৭৩ মিনিট মাঠে মাত্র ২টি শট নেওয়া দেজিরে দুয়োও তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি ম্যাচে। এ দুজনের মতোই জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন খিচা কাভারাস্কেইয়া। একেবারেই ছন্দহীন থাকা এই উইঙ্গারকে ৫৮ মিনিটে তুলে নেন কোচ লুইস এনরিকে। মাঠ ছাড়ার আগে তিনিও নিতে পেরেছেন মাত্র ১টি শট। এমনকি বলের নাগালও পেয়েছেন কমই। মাঠে মাত্র ২৩ বার বলের স্পর্শ পেয়েছেন এই জর্জিয়ান। আক্রমণভাগের নিয়মিত তারকাদের এমন পারফরম্যান্সই পিএসজির জন্য শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছে।
গতকাল রাতে প্রথমার্ধে পিএসজির রক্ষণকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলায় মেতেছিলেন কোল পালমার। তাঁকে থামানোর কোনো পরিকল্পনাই যেন ছিল না পিএসজির। ফলে পিএসজির রক্ষণকে শুরু থেকেই চেপে ধরেন এই ইংলিশ ফরোয়ার্ড। ৯০ মিনিটে ৪টি শট নিয়ে ২টি গোল করেছেন পালমার। আর অন্য গোলটিও হয়েছে তাঁর অ্যাসিস্টে।
পরিসংখ্যান দিয়ে অবশ্য পালমারের অবদান বোঝা যাবে না। অ্যাটাকিং থার্ডে যখনই পালমারের পায়ে বল গেছে, তখনই পিএসজির জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু ফাইনালেই নয়, টুর্নামেন্টজুড়ে পালমার দারুণ খেলেছেন। সব মিলিয়ে ৩ গোল এবং ২টি অ্যাসিস্ট করা এই ইংলিশ তারকা জিতেছেন প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলও।
কিছুদিন ধরে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে কৌশলের মাস্টারক্লাসে কুপোকাত করেছেন পিএসজি কোচ এনরিকে। কিন্তু কাল সেই এনরিকে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে দেখলেন চেলসি কোচ এনজো মারেসকার মাস্টারক্লাস। মারেসকার প্রথম ১০ মিনিটেই ম্যাচ জিতে নেওয়ার যে কৌশল, সেটি দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে তাঁর শিষ্যরা। শুরু থেকেই গতিময় ও আগ্রাসী ফুটবল উপহার দেয় তারা।
মূলত পিএসজিকে তাদের কৌশলেই চেপে ধরার মন্ত্র নিয়ে মাঠে নামে চেলসি। প্রেসিংয়ের পর প্রেসিংয়ে একরকম কোণঠাসা করে রাখা হয় প্যারিসের দলটিকে। পিএসজিকে মাঠে জায়গা নিয়েও খেলতে দেয়নি চেলসি। শেষ পর্যন্ত এই চাপ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোনো সুযোগই পায়নি পিএসজি। প্রথমার্ধেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় তারা।
ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড হোয়াও পেদ্রোর ক্লাব বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিল না। ২ জুলাই ব্রাইটন ছেড়ে চেলসিতে আসেন তিনি। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় চেলসির ক্লাব বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। দুই দিন পর টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে অভিষেকও হয়ে যায় তাঁর। তবে হোয়াও পেদ্রো নিজেকে চেনান সেমিফাইনালে।
ফ্লুমিনেন্সের বিপক্ষে সেই ম্যাচে চেলসির ২-০ গোলের জয়ে দুটি গোলই আসে তাঁর কাছ থেকে। এরপর গতকাল ফাইনালেও গোল করেছেন পেদ্রো। মূলত তাঁর করা ম্যাচের তৃতীয় গোলটিই পিএসজির ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা একরকম বন্ধ করে দেয়। সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে চমকের কথা বললে পেদ্রোর চেলসি দলে অন্তর্ভুক্তির কথাই বলতে হবে, যা শেষ পর্যন্ত চেলসিকে শিরোপা জিততেও সহায়তা করেছেন।