রেস্তোরাঁর টেবিলে বসে মেসির গল্প

আলেক্স দে লা ইগ্লেসিয়া। আর্জেন্টিনার সিনেমার জাদুকর বলা চলে তাঁকে। রহস্য আর আবেগের সেলাই মেলাতে ওস্তাদ। কিন্তু ২০১৪ সালে তিনি যে ছবিটা বানালেন, তাতে নেই ভূত, নেই রক্তারক্তি—আছে এক জীবন্ত কিংবদন্তির শৈশব, স্বপ্ন আর সংগ্রামের গল্প। ছবির নাম—‘মেসি’।

চিত্রনাট্য লিখেছেন হোর্হে ভালদানো, যিনি শুধু আর্জেন্টাইন বিশ্বকাপজয়ী নন, ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় ও কোচও। ফলে বার্সেলোনাকেন্দ্রিক এই ছবিতে তাঁর উপস্থিতি একটু চমক জাগানো হলেও, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছবিটিকে দিয়েছে এক ভিন্ন রকম গভীরতা।

মেসি সিনেমার একটি দৃশ্য

ছবিতে কোনো কথক নেই, নেই ন্যারেশন। বদলে আছে একখানা রেস্তোরাঁ, সেখানে জড়ো হয়েছেন মেসির জীবনের কাছের মানুষেরা। নানা টেবিলে তাঁরা আড্ডা দেন, গল্প বলেন—আর সেই গল্পে খুলে যায় এক শিশুর বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ, যার নাম লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।

মেসির ছোটবেলার বন্ধুরা, তাঁর শহরের কোচ, জাতীয় দলের পরিচালক, বার্সেলোনার সতীর্থ, সাংবাদিক, এমনকি সেই চিকিৎসক—যিনি ছোট্ট মেসির শরীরের বৃদ্ধির সমস্যার চিকিৎসা করেছিলেন—সবাই আছেন এই আলোচনায়। একেকজনের মুখ থেকে শোনা যায় চমকপ্রদ সব গল্প।

মেসি সিনেমার একটি দৃশ্য

পুরোনো ভিডিও, খেলার ক্লিপ, রেকর্ড করা কথোপকথনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে সেই গল্প। মেসি নিজে নতুন করে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি, কিন্তু তাঁর পুরোনো কথাগুলো যেন নতুনভাবে প্রাণ পেয়েছে পর্দায়। মেসিকে নিয়ে ভালদানো, সিজার লুইস মেনোত্তি ও ইয়োহান ক্রুইফের মন্তব্যগুলোতে পাওয়া যাবে গভীর ফুটবল-দর্শনও।

তথ্যচিত্রে কিছু অভিনীত দৃশ্যও আছে—মেসির মা–বাবা, তাঁর শৈশবের নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন অভিনেতারা। মেসির হরমোনজনিত সমস্যা, ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা, মাঠের বাইরে চুপচাপ থাকা মেসির মাঠে নামলেই আগুন হয়ে ওঠা, আর একটি বিশেষ ঘটনা—বাথরুমে আটকে পড়ে, ভেন্টিলেটর ভেঙে বেরিয়ে এসে কীভাবে দলকে জিতিয়েছিলেন মেসি!

মেসি

তবে সবচেয়ে আবেগঘন অংশটা হলো মেসির দাদির গল্প। ছোটবেলায় যিনি তাঁকে মাঠে নামিয়েছিলেন, গোল করলে যাঁকে উৎসর্গ করতেন মেসি। ছবিতে ছোটবেলার মেসির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভ্যালেন্তিনো আকুনিয়া, যদিও দেখা যায় শুধু তাঁর পা! পুরো ছবিতে তাঁর মুখ দেখানো হয়নি!
ইগ্লেসিয়ার নির্মাণশৈলীও আলাদা। কোথাও বাস্তব দৃশ্য ঢুকে পড়ে অভিনয়ের ফাঁকে, কোথাও নাটকের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সত্য। পুরো ছবির আবহটাই যেন একধরনের কবিতা—চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্যানভাস, আর তাতে রংতুলির মতো ফুটে ওঠে একজন কিংবদন্তির শৈশব, লড়াই, নিঃসঙ্গতা আর সাফল্যের গল্প।

শুরুর দিকে ছবিটি বেশ তরতর করে এগোয়, মাঝখানে হয়তো খানিকটা গতি হারায়, কিন্তু শেষটায় আবার হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা মারে। কিছু কিছু ঘটনা খুঁটিয়ে দেখানো হয়েছে, আর কিছু কেবল ছুঁয়ে গিয়েছে হালকাভাবে। কিন্তু তার মধ্যেও ফুটে উঠেছে মেসির মানুষ হয়ে ওঠার এক অনন্য উপাখ্যান।
এই ছবির কেন্দ্রবিন্দু কেবল মেসি নয়, তাঁর চারপাশের মানুষগুলোও—যাঁরা তাঁকে গড়ে তুলেছেন, ভালোবেসেছেন, বুঝেছেন। ছবিটি স্প্যানিশ ভাষার হলেও ইউটিউবে ইংরেজি সাবটাইটেলসহ সহজেই দেখা যায়।
যদি আপনি হন মেসিপ্রেমী, তবে এই ছবি দেখতে দেখতে কখন যে চোখ ভিজে যাবে, টেরও পাবেন না।

মেসি (২০১৪)

পরিচালক: আলেক্স দে লা ইগ্লেসিয়া
চিত্রনাট্য: হোর্হে ভালদানো
মুক্তি: ২০১৪
ধরন: তথ্যচিত্র
আছেন: মেসি, ইউহান ক্রুইফ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, হাভিয়ের মাচেরানো, সিজার লুইস মেনোত্তি, জেরার্ড পিকে, আলেহান্দ্রো সাবেয়া, হোর্হে ভালদানো প্রমুখ।
আইএমডিবি রেটিং: ৭.১/১০
রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট