দুই পুরস্কার হাতে ঋতুপর্ণা চাকমা
দুই পুরস্কার হাতে ঋতুপর্ণা চাকমা

বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ

জোড়া পুরস্কারে আলোকিত ফুটবল–রত্ন

একই পুরস্কারের মঞ্চে দুবার ডাক—এমন সৌভাগ্য হয়তো খুব কম ক্রীড়াবিদেরই হয়। সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার ২০২৪-এর মঞ্চে প্রথমবার বিচারকদের বেছে নেওয়া বর্ষসেরার পদক হাতে নিয়ে যখন ঋতুপর্ণা চাকমা উঠলেন, হলভর্তি করতালির স্রোত।

ঠিক পরের মুহূর্তে পাঠকদের হৃদয় জয় করে দ্বিতীয়বার বর্ষসেরার খেতাব জিতলেন তিনি, আবারও ছড়িয়ে পড়ল আলো। এক বিকেলে দুটি জয়, যাঁর কেন্দ্রে থাকা ঋতুপর্ণা হয়ে উঠলেন পুরো অনুষ্ঠানেরই প্রধান আকর্ষণ।

ভুটান থেকে বিশেষ ছুটি নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় এসেছেন রাঙামাটির মেয়ে। দুই হাত ভরে বর্ষসেরার পুরস্কার, মুখে লাজুক কিন্তু প্রাণবন্ত হাসি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘আমি খুব খুশি। সবাইকে অভিনন্দন। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক, পরিবার, ফুটবলভক্ত ও বাফুফের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।’

এক ফাঁকে স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন বহুদূর, ‘আমরা দুবার সাফ সেরা হয়েছি, এবার এশিয়ার মঞ্চে খেলব, বাংলাদেশকে বিশ্ব মঞ্চেও নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করব।’

ঋতুপর্ণার হাতে বর্ষসেরার পুরস্কার তুলে দেন রানী হামিদ

উপস্থাপক যখন দুই লাইনের গান শোনার অনুরোধ করলেন, ঋতুপর্ণার মুখে হাসি ফুটে উঠল ‘ফুটবল ছাড়া আর কিছু পারি না।’ ফুটবলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর দক্ষতা এতটাই যে অনেকবারই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। দেশের নারী ফুটবলে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা এখন ঋতুপর্ণাই।

কালো পোশাক পরে অনুষ্ঠানে এসেছেন। কী পুরস্কার পাবেন তখনো জানতেন না। ১১ আগস্ট ফিরবেন ভুটানে, সঙ্গে নিচ্ছেন জোড়া পুরস্কার জয়ের আনন্দ, যা তাঁকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে আরও সুন্দর গোল করতে অনুপ্রেরণা দেবে। অনুষ্ঠান শেষে বললেনও তা, ‘এই পুরস্কার আমাকে আরও উজ্জীবিত এবং ভালো খেলতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। চেষ্টা করব নিজেকে আরও সামনে নিতে যেতে। আর ভালো ভালো গোল করতে।’

২০২৪ সালে ঋতুপর্ণা চাকমা ফুটবল মাঠে যে দুর্দান্ত ছাপ ফেলেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে অনেক বছর। কাঠমান্ডুতে সাফ ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে তাঁর বাঁ পায়ের জয়সূচক গোল বাংলাদেশের নারী ফুটবল ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। বাঁ দিক থেকে নিখুঁত শটে নেওয়া বলটি নেপালের গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে জালে ঢোকে। প্রায় ২০ হাজার দর্শক মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায়। সেই গোলের পর ঋতুপর্ণার মুখে আঙুল চেপে রাখা ভঙ্গিটি ছিল বিশেষ এক মুহূর্ত, যা সেদিন সারা দেশে আলোড়ন ফেলেছিল।

ঋতুপর্ণার হাতে পাঠকের ভোটে বর্ষসেরার পুরস্কার তুলে দেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ

বাংলাদেশের ফুটবলে ঋতুপর্ণার সেই দর্শক-চুপ করার বিখ্যাত ভঙ্গিটা সত্যিই গৌরবের এক ছবি হয়ে আছে। মঞ্চে সেটি আবার দেখানোর জন্য অনুরোধ করা হলেও ঋতু হেসে বললেন, ‘ওটা তো মাঠেই করি, মঞ্চে নয়।’ তবু দর্শক সারিতে করতালি থামছিল না। উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে উঠেছিল পুরো অনুষ্ঠানস্থল।

গত জুলাইয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে তাঁর দুটি গোল ছিল বাংলাদেশের নারী ফুটবলের অন্যতম উজ্জ্বল মুহূর্ত। প্রথম গোলটিতে তাঁর ফ্রি–কিক দেয়ালে লেগে ফিরে আসা বল নিজেই নিখুঁত শটে জালে পাঠান। দ্বিতীয়টিতে বক্সের বাঁ পাশ থেকে অসাধারণ শটে বল গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে জালে। গ্যালারি স্তব্ধ, প্রতিপক্ষ হতভম্ব। র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় নিশ্চিত হয় তাঁর সেই জোড়া গোলেই।

জুরিবোর্ড ও পাঠকদের ভোটে বর্ষসেরা হয়েছেন ঋতুপর্ণা চাকমা

সেই জয় বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে। বাঁ পায়ের গতি, বল নিয়ন্ত্রণ ও শুটিং দক্ষতায় ঋতু আজ দেশের সেরা আক্রমণভাগের অস্ত্র। অনেকে চোখে, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেট। যিনি বাঁ পায়ে শুধু গোল করেন না, বাঁ হাতে লেখেনও।

কিন্তু কীভাবে বাঁ পায়ে এত চোধজুড়ানো গোল করেন? উপস্থাপকের প্রশ্নে ঋতুপর্ণার সপ্রতিভ উত্তর, ‘এমন গোল আমি অনুশীলনেও করি। চেষ্টা করি ভালো গোল করতে।’
শুধু গোল করাই নয়, গোল করাতেও পারদর্শী ঋতুপর্ণা। ২০২২ ও ২০২৪ সালের বাংলাদেশের দুই সাফজয়ী দলের গর্বিত সদস্য তিনি। যেখানে প্রথমবার সাফে আলো ছিল সাবিনা খাতুনের ওপর, গতবার কাঠমান্ডুতে সেই আলো পড়ে ঋতুপর্ণার ওপর। সাফের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার তাঁর ফুটবল প্রতিভাকে দিয়েছে এক নতুন মর্যাদা ও স্বীকৃতি।

আজকের ঋতুপর্ণা শুধু একজন ফুটবলার নন—লড়াই, স্বপ্ন ও দৃঢ়তার অনন্য প্রতীকও। প্রতিভা আর অধ্যবসায় মিলিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। এবারের সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে জোড়া বর্ষসেরা পুরস্কার তাঁর অর্জনের খাতায় যোগ করেছে নতুন অধ্যায়।