২০০৩ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দল
২০০৩ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দল

কেমন ছিল ২২ বছর আগে ভারতের বিপক্ষে গোল্ডেন গোলের সেই স্মরণীয় জয়

১৮ জানুয়ারি, ২০০৩।

শনিবারের বিকেল।

ঢাকার আকাশ-বাতাসে তখন একটাই নাম বারবার প্রতিধ্বনি তুলছিল: মতিউর রহমান মুন্না!

জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারি যেন নিজেই স্লোগান হয়ে ফেটে পড়েছিল—‘মুন্না! মুন্না!’
বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাসে মুন্না এক চিরকালীন অমর নাম। কারণ, ২০০৩ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তাঁর সেই ‘গোল্ডেন গোল’। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে সমতা। অতিরিক্ত সময়ের ৯৮ মিনিটে স্বপ্ন বহন করা মিডফিল্ডার মুন্নার বাঁ পায়ের শট ২৫ গজ দূর থেকে বুলেট গতিতে জড়িয়ে গেল ভারতের জালে! তারপর শেষ বাঁশি! ম্যাচ জিতে গেল বাংলাদেশ।

আশ্চর্য হলেও সত্যি, এটিই ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ জয়। অবশ্য কাগজ-কলমে ম্যাচটি ড্র হিসেবেই রেকর্ড করা আছে।

কিন্তু রেকর্ডের পাতায় যা-ই লেখা থাকুক, তার চেয়েও বড় কথা হলো, ২০০৩ সালের ১৮ জানুয়ারির সেই দিনটা ছিল বাংলাদেশের ফুটবলে আনন্দযজ্ঞের দিন! আজ (মঙ্গলবার) রাত আটটায় ঢাকায় যখন বাংলাদেশ–ভারত আরেকটি ম্যাচে নামবে, তখন বাংলাদেশের পুরোনো ফুটবলপ্রেমীদের মন নিশ্চিতভাবেই ফিরে যেতে চাইবে, সেই জয়ের দিনটিতে।

সেই জয় আজও বাংলাদেশের ফুটবল মানচিত্রে এক উজ্জ্বলতম বিন্দু হয়ে আছে। ফিফা তখন নকআউট ম্যাচ অমীমাংসিত থাকলে অতিরিক্ত সময়ে গোল্ডেন গোল নিয়ম চালু করেছিল—অর্থাৎ এক গোল হলেই খেলা শেষ। আর, বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র গোল্ডেন গোলে জয় এনে দিয়েছিলেন মুন্নাই।

ভারতের বিপক্ষে মিডফিল্ডে সেদিন আস্থার প্রতীক হয়ে ছিলেন আরমান মিয়া

মুন্না নায়ক হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নায়ক হওয়ার সুযোগ ছিল রোকনুজ্জামান কাঞ্চনেরও। তাঁর গোলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। ৭৭ মিনিটে আরমানের কর্নার থেকে ভারতের রক্ষণ ফাঁকি দিয়ে কাঞ্চনের নিখুঁত হেড জড়ায় জালে।

কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফেরে ভারত। ৮১ মিনিটে মাঝমাঠে বাংলাদেশ বল হারায়, তা পৌঁছে যায় বদলি মিডফিল্ডার আলভিটো ডি কুনহার কাছে। সামনে তিন ডিফেন্ডার, পেছনে গোলরক্ষক আমিনুল। আলভিটো চাতুর্যের সঙ্গে শট নেন পোস্টে। আমিনুল নাগাল পেলেন না। তাঁর বিশ্বস্ত হাত ফাঁকি দিয়ে বল ঢুকে যায় জালে। আপাত নিরীহ সেই শট স্তব্ধ করে দেয় বাংলাদেশকে। সুজন, রজনী, নজরুল—বাংলাদেশের তিন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের দেয়াল গলে গোল করে ফেলে ভারত।

যে আমিনুল বহু যুদ্ধে নায়ক, যিনি ফ্লাইট বুঝে অনেক আক্রমণ রুখেছেন, তিনি সেদিন পরাস্ত। তবু চেষ্টা করেছেন সেরাটা দিতে। নজরুল রক্ষণে একটু ভুল করেছিলেন। তবে মাঝমাঠে আরমান মিয়া তাঁর শিল্পের ছোঁয়া দিয়েছেন। আলফাজ ঢেলে দিয়েছেন আক্রমণে। তাঁর স্মৃতিতে মুন্নার গোলটাই বেশি ভাসে ২২ বছর পর, ‘মাঝমাঠে মুন্না আমার সঙ্গে ওয়াল খেলেছিল। তারপর বল নিয়ে সামনে এগোয়। আর আচমকা শট মারে ভারতের পোস্টে। যেন অলৌকিক এক গোল। আমরা ভাবিনি এভাবে গোল করে জিতে যাব। সে ছিল অনন্য এক অনুভূতি।’

প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার আই এম বিজয়নও অসাধারণ খেলেছিলেন। নিচে নেমে ছোট্ট ব্যাক-হিল, মাপা ভলিতে গোলমুখ খুলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দিনশেষে কেরালার ‘কালো হরিণ’ ছিলেন পরাজিত দলে।

ভারতের বিপক্ষে সেদিন মাঝমাঠে আরিফ খানও দাপট দেখান

এক পাশে আনন্দ, অন্য পাশে বেদনা—এভাবেই অনবদ্য এক ফুটবল ম্যাচ হয়ে ওঠে সেটি। ম্যাচে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। শুরুতে কাঞ্চনের হেড গোললাইন থেকে ফিরে আসে। জয়ের ভলি বাইরে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে ফাঁকা পোস্টে বল গেল না। ভাগ্য ভারতের পক্ষে ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

২০০৩ সালের সেই বাংলাদেশ দলে ছিলেন: আমিনুল, সুজন, নজরুল, রজনী, পারভেজ বাবু (ফরহাদ), হাসান আল মামুন (টিটু), মতিউর মুন্না, আরমান, জয়, আলফাজ (উজ্জ্বল), কাঞ্চন।

বিকেল থেকেই স্রোতের মতো মানুষ এসেছে মাঠে। কতকাল এমন ভিড় দেখা যায়নি! ভারত গোল করার পর উত্তাল গ্যালারি মুহূর্তে নিস্তব্ধ। উপচে পড়া ৫০ হাজার দর্শকের মধ্যে তখন একটা পিন পড়লেও শব্দ শোনা যেত। কিন্তু মুন্নার গোলের পর আবার সবাই উজ্জীবিত। ম্যাচ শেষে জনতার সব পাওয়া যেন এক বিন্দুতে মিশে গেল। ফুটবল আবার স্বপ্নের চেহারা নিয়ে ফিরে এল জাতীয় স্টেডিয়ামে।

সেদিন প্রেস বক্সে বসে খেলা দেখতে দেখতে রোমাঞ্চ হচ্ছিল এই প্রতিবেদকেরও। মুন্নার গোলটা এখনো চোখে লেগে আছে। লেগে আছে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ছবিটা। জাতীয় স্টেডিয়ামে মানুষের এত উচ্ছ্বাস কমই দেখা গেছে।

নিয়মরক্ষার খাতিরে ম্যাচোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এলেছিলেন ভারতের ম্যানেজার দেবজ্যোতি মুখার্জি। তিনি ছিলেন বাঙালি। বাংলায় কথা বলেছেন। বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মনে পড়ছে বাংলাদেশ কোচ জর্জ কোটানের কথা। বাংলাদেশের ফুটবলে চির ভালোবাসার এক মানুষ। যিনি কখনো নিজেকে অস্ট্রিয়ান ভাবেননি। ভেবেছেন বাংলাদেশি। বাংলাদেশের ২০০৩ সাফ জেতার অগ্রণী নায়ক প্রয়াত হয়েছেন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে।

গোল্ডেন গোল করেছিলেন মতিউর মুন্না। ছবিটি

সেমিফাইনালে বলা তাঁর কথাগুলো কানে বাজে আজও, ‘আমরা ভারতের চেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছিলাম। কিছু সময় বাদ দিলে পুরো সময়ই আমরা ভালো খেলেছি।’ কোটান আরও বলেছিলেন, ‘নির্ধারিত সময়েই ম্যাচটা শেষ হওয়া উচিত ছিল। কাঞ্চন দারুণ গোল করেছে।’

শুধু সেই সেমিফাইনাল নয়, ফাইনালেও গোল করেছিলেন কাঞ্চন। সে সময় অনেকের চোখে সেরা স্ট্রাইকার ছিলেন তিনি। ভারত ম্যাচ নিয়ে আজ এত বছর পর পেছনে ফিরে কাঞ্চন আপ্লুত। ঢাকা স্টেডিয়ামে ম্যাচ দেখতে যাবেন। ২২ বছর পেছনে ফিরে বলেন, ‘ওই ম্যাচে আমার গোল ছিল আসলে দুটি। একটা গোল দেয়নি থাইল্যান্ডের রেফারি। বল পোস্টে ঢুকলেও গোল দেয়নি। তখন প্রযুক্তি ছিল না। প্রযুক্তি থাকলে গোল দিতে হতো। বাফুফের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু ভাই বলেছিলেন, আমার গোলটা ছিল ওই মাসের সেরা গোল।’ কাঞ্চনের আরও কথা, ‘ভারত সারা জীবনই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমাদের সময় আবাহনী–মোহামেডানের মতো সম্পর্ক ছিল তাদের সঙ্গে।’

২২ বছর কেন ভারতকে হারাতে পারে না বাংলাদেশ? মাঝে ১০টি ম্যাচ খেলেছে দুই দেশ, যার ছয়টি ড্র, চারটিতে ভারতের জয়। কাঞ্চন বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনার অভাব। তা ছাড়া খেলোয়াড়দের কোথাও ঘাটতি আছে। কোচ কাবরেরাও ঠিক পারছেন না দলটা চালাতে। উনি আসলে কোচ নয়, ট্রেনার। কোচ হলে রাকিবের মতো খেলোয়াড়কে রাইট ব্যাকে খেলাতেন না।’

এখানেই শেষ নয়। কাঞ্চন বলতে থাকেন, ‘গোলকিপার মিতুলের আত্মবিশ্বাসের অভাব। অথচ তাকেই খেলাচ্ছে। এমন কোচের অধীনে আমরা ভারতকে হারাব বিশ্বাস করা কঠিন।’

ভারতের বিপক্ষে আজ বাংলাদেশের জয়ের নায়ক কি হতে পারবেন হামজা চৌধুরী

সেই ম্যাচের নায়ক মুন্না আজ ফুটবল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাঁর সমসাময়িক কেউ কোচিংয়ে, কেউ সংগঠক হিসেবে মাঠে আছেন। মুন্না বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ। কয়েক বছর আগেই হয়ে গেছেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। ঢাকাতেই আছেন। তবে ঠিক কোথায় আছেন জানা নেই। তাঁর হদিস দিতে পারেন না তাঁর এক সময়ের সতীর্থরাও।

স্টেডিয়ামে এসে আজকের ম্যাচ দেখবেন না—এটা ধরে নেওয়াই যায়। তবে যেখানেই থাকুন, টিভিতে চোখ রাখবেন নিশ্চয়ই।

একজন ফুটবলারের ক্যারিয়ারে সব মুহূর্ত ইতিহাস হয় না। মুন্না সৌভাগ্যবান যে তাঁর একটি মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরেছে পুরো ফুটবল জনতা।

জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ কি আজ খুঁজে পাবে মুন্নার পর নতুন কোনো জয়ের নায়ক? কে হবেন তিনি—হামজা চৌধুরী, শমিত সোম, রাকিব হোসেন, নাকি অন্য কেউ?