আর্জেন্টিনার যুবাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন প্লাসেন্তে
আর্জেন্টিনার যুবাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন প্লাসেন্তে

জেল খাটা কোচের হাত ধরে ১৮ বছর পর বিশ্বকাপ জেতার অপেক্ষায় আর্জেন্টিনা

অনেক সময় ব্যর্থতা যখন চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে, তখন সবার অপেক্ষা থাকে পথপ্রদর্শকের জন্য—যিনি এসে সব জীর্ণতা ও সংকট থেকে উদ্ধার করবেন। আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক ফুটবলে তেমনই এক ত্রাতা হয়ে এসেছেন ডিয়েগো প্লাসেন্তে। তাঁর হাত ধরে ১৮ বছর পর আবারও অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব–২০ দল। এখন অপেক্ষা শিরোপা জয়ের।  

একসময় আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ও বায়ার লেভারকুসেনসহ বিভিন্ন দলে খেলা সাবেক লেফটব্যাক প্লাসেন্তে বর্তমানে আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব–২০ দলের কোচ। তাঁর অধীনে আগামী সোমবার অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে মরক্কোর মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটায় শুরু হবে এই ম্যাচ।

আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দলের হয়ে মাঠে পাওয়া সাফল্যের পাশাপাশি প্লাসেন্তের জীবনে কিছু চমকপ্রদ ঘটনাও আছে।

১৯৯৫ সালে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক প্লাসেন্তের। দারুণ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তিনি দ্রুত নজর কাড়েন রিভার প্লেটের এবং দুই মৌসুম পরই যোগ দেন সেখানে।

রিভার প্লেটে সফল সময় কাটানোর পর প্লাসেন্তে পাড়ি জমান জার্মান ক্লাব বায়ার লেভারকুসেনে। ইউরোপে পরবর্তী সময়ে তিনি আরও খেলেছেন স্পেনের সেল্তা ভিগো এবং ফ্রান্সের বোর্দোয়। এরপর দেশে ফিরে দক্ষিণ আমেরিকার পরাশক্তি আর্জেন্টিনার সান লরেঞ্জো ও উরুগুয়ের ন্যাসিওনাল দে মন্টেভিদেওর মতো ক্লাবের হয়েও খেলেছেন প্লাসেন্তে।

শুধু ক্লাব পর্যায়েই নয়, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলেও একসময় খেলেছেন প্লাসেন্তে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জিততে সাহায্য করেছিলেন, আর মূল জাতীয় দলে খেলেছেন ২০০২ সালের বিশ্বকাপে এবং ২০০৪ কোপা আমেরিকায়। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ২২ ম্যাচ খেলেছেন প্লাসেন্তে।

তবে শুধু ফুটবলার পরিচয়ে তাঁকে আটকে রাখার সুযোগ নেই। ফুটবলের পাশাপাশি তাঁর ভালোবাসা ছিল সংগীতে, বিশেষ করে আর্জেন্টাইন রক গান। জীবনের অজানা দিক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্লাসেন্তে একবার বলেছিলেন, তিনি ‘লস রেদোন্দোস’ ব্যান্ডের ভক্ত। এমনকি ব্যান্ডটির কনসার্ট মিস না করতে অদ্ভুত কিছু কাজও করেছিলেন।

১৮ বছর পর শিরোপা জয়ের অপেক্ষায় আর্জেন্টিনা দল

২০০০ সাল। তখন মাত্র ২৩ বছরের তরুণ প্লাসেন্তে। রিভার প্লেটে মূল দলে নিয়মিত। সে সময় নবম রাউন্ডে রিভার প্লেটের ম্যাচ ছিল ভেলেজের মাঠ আমালফিতানিতে। কিন্তু মাঠে নেমে একটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর—যেভাবেই হোক হলুদ কার্ড দেখা। কাঙ্ক্ষিত হলুদ কার্ডটি দেখলে দশম রাউন্ডে অর্থাৎ পরের ম্যাচে নিষিদ্ধ হবেন, কিন্তু তিনি একাদশতম রাউন্ডে বোকা জুনিয়র্সের বিপক্ষে ‘সুপার ক্লাসিকো’য় খেলতে পারবেন। পাশাপাশি মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে লস রেদোন্দোস ব্যান্ডের কনসার্টও উপভোগ করতে পারবেন।

টিওয়াইসি স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসতে হাসতে প্লাসেন্তে বলেছেন, ‘আমাকে একটা হলুদ কার্ড দেখতেই হতো। আমি চেয়েছিলাম সেটা যেন ওই সপ্তাহেই পাই, কারণ তখনই লস রেদোন্দোসের কনসার্ট ছিল। মজার ব্যাপার হলো, আমি এক–দুবার ফাউল করলাম, কিন্তু (রেফারি) কার্ড দেখাননি। তখন আমি ডিফেন্ডারদের চেনা চালটা দিলাম—সময় নষ্ট করতে শুরু করলাম। আর তখনই তিনি কার্ড দেখালেন!’

প্লাসেন্তে আরও বলেন, ‘আমি ১৫ বছর বয়স থেকেই লস রেদোন্দোস ব্যান্ডের ভক্ত। তারা রিভার প্লেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান করতে এলে আমার পক্ষে সেই কনসার্টে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই আমি এক ঢিলে দুই পাখি মারলাম। একদিকে বোকা জুনিয়র্সের বিপক্ষে সুপারক্লাসিকো ম্যাচে খেললাম, অন্যদিকে রিভার প্লেট স্টেডিয়ামেই লস রেদোন্দোসের কনসার্ট দেখলাম।’

ব্যান্ডের গায়ক কার্লোস আলবের্তো সোলারির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে প্লাসেন্তে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি হুয়ান রোমান রিকেলমের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। প্লাসেন্তে যোগ করেন, ‘আমি চাইতাম একজন সংগীতশিল্পী হতে। কিন্তু আমি বাদ্যযন্ত্র ভালো বাজাতে পারি না। আমি সংগীতময় জীবন ভালোবাসি। ওরা যেভাবে পেশাগতভাবে জীবন উপভোগ করে, সেটা আমার খুব পছন্দ। আমি তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও একটু হিংসাও অনুভব করি।’

প্লাসেন্তের জীবন অবশ্য সব সময় সংগীতের মতো সুরময় ছিল না। একটি ঘটনা বেশ ঝড় তুলেছিল আর্জেন্টাইন কোচের জীবনে। সেটা ২০১৩ সাল। তত দিনে পেশাদার ফুটবল ছেড়েছেন প্লাসেন্তে। একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। কিন্তু সেখানে অপ্রত্যাশিত এক বিপদের সম্মুখীন হন।

কৌশল সাজাচ্ছেন প্লাসেন্তে (বাঁয়ে)

২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বায়ার লেভারকুসেনের খেলোয়াড় থাকতে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ছিল প্লাসেন্তের বিরুদ্ধে। সেবার জার্মানিতে গিয়ে তাই তদন্তের সন্মুখীন হন। যেহেতু তিনি জার্মানির বাসিন্দা ছিলেন না, তাঁকে রাখা হয় সাধারণ কারাগারে। কারাগারে নিয়ে যাওয়া বাসে একটি কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরেছিলেন এবং পায়েও কড়া লাগানো ছিল। প্লাসেন্তে ২৮ দিন কারাভোগ করেন। সাংবাদিক হুয়ান পাবলো ভারস্কিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্লাসেন্তে বলেছেন, ‘যখন আমি বিমানবন্দরে পৌঁছালাম, চেকপয়েন্ট পার করার সুযোগও পাইনি। তারা বলল যে আমি কর বাকি রেখেছি।’

২৮ দিনের কারাজীবনে অন্য বন্দীদের সঙ্গে ফুটবল খেলে কাটানো সেই সময় নিয়ে প্লাসেন্তে বলেছেন, ‘কিছু দিন তারা একটু বেশি স্বাধীনতা দিত, যাতে লম্বা সময় সেলে বন্দী থাকতে না হয়। কোচ পুরো দলকে একত্রিত করে আমাকে নাম্বার ৩ জার্সি দেয়। আমি বললাম, “আমাকে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলতে দাও।” একসময় এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাই, সবকিছু মানিয়ে নিই।’ প্লাসেন্তে অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হন। জেল থেকে বের হওয়ার পর থেকে প্লাসেন্তে আর কখনো জার্মানিতে যাননি। তবে ভবিষ্যতে যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁর আছে।

কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে জার্মানিতে প্লাসেন্তে ২৮ দিন কারাভোগ করেন।

২০১৩ সালেরই আরেকটি ঘটনা। প্লাসেন্তে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স কোচ রিকার্দো কারুসো লোমবার্দির সঙ্গে। প্লাসেন্তে সে সময় তাঁর ক্লাব ছাড়ার জন্য দায়ী করেন কারুসোকে। তাতে কারুসো দ্রুতই রেগে যান এবং প্রতিক্রিয়া দেখান। মাইক্রোফোন হাতে অনুশীলন শেষে ক্যামেরার সামনে তিনি বলেন, ‘এই বোকা আমাকে কলঙ্কিত করতে পারবে না।’ প্লাসেন্তেকে কারুসো তখন ‘অহংকারী ছোকরা’ বলে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করেন। একই সময়ে প্লাসেন্তেও বেশ বাজেভাবে টেলিভিশন চ্যানলগুলোতে গিয়ে কারুসোকে আক্রমণ করেন। এসব ঝামেলার মধ্যে সে বছর ফুটবলকে বিদায় বলেন প্লাসেন্তে।

বিতর্কের দিনগুলো পেছনে ফেলে প্লাসেন্তে অবশ্য এখন দুর্দান্ত এক মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে। অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল মরক্কোকে হারাতে পারলে প্লাসেন্তে পরিণত হবেন জাতীয় নায়কে।