ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার চোখ এখন বিশ্বকাপে
ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার চোখ এখন বিশ্বকাপে

ফুটবলে এই বছরটা কেমন কাটল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার

বিশ্বকাপের ক্ষণ গুনতে গুনতে ২০২৫ সালকে বিদায় জানাল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ফুটবল দল। সামনের ২০২৬ দুই দেশের জন্যই মহাগুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকাপের বছর বলে কথা! চার বছর ধরে ফুটবলের পরাশক্তি দেশগুলো অপেক্ষায় থাকে এই সময়টির। বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে চার বছরের জন্য নিজেদের সিংহাসন ও মর্যাদাকে সমুন্নত করার এটিই একমাত্র উপলক্ষ।

আর বিশ্বকাপ মানেই উত্তাপের বড় একটি অংশজুড়ে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার নাম। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ আমেরিকার এই দুই দেশের কোটি সমর্থক নিজ দলের হাতে ট্রফি দেখার অপেক্ষায় থাকেন। সর্বশেষ ২০২২ সালে এই অপেক্ষাটা ঘুচেছিল আর্জেন্টিনা সমর্থকদের, লিওনেল মেসিরা ট্রফি হাতে তুলেছেন ৩৬ বছর পর। ব্রাজিলের এখনকার অপেক্ষাটা ২০০২ সালের পর থেকে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৬ বিশ্বকাপের আগের বছরে দুই দেশ কেমন খেলল, দেখে নেওয়া যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে এই দশকটাকে কেউ চাইলে আর্জেন্টিনা ও লিওনেল মেসির দশক হিসেবেও মনে রাখতে পারে। ২০২২ বিশ্বকাপ জিতে ফুটবলে নিজেদের হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধার করেছে ‘আলবিসেলেস্তে’রা। এর আগে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জিতে আর্জেন্টিনার উত্থানের গল্পটা শুরু হয়েছিল।

সেবার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের জানান দেয় মেসির আর্জেন্টিনা। এরপর ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে ফিনালিসিমাও জিতে নেয় তারা। আর বিশ্বকাপের পর গত বছর আর্জেন্টিনা জিতেছে টানা দ্বিতীয় কোপা আমেরিকা শিরোপা। মেসিকে ঘিরে আর্জেন্টিনায় এখন নতুন একটি ফুটবল–প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেছে। ২০২৬ বিশ্বকাপে ব্যাটনটা থাকবে তাঁদের হাতেই।

২০২৫ সালে আর্জেন্টিনার পারফরম্যান্স ছিল মূলত আগের চার বছরের ধারাবাহিকতা। লিওনেল স্কালোনির অধীনে আর্জেন্টিনার অবিশ্বাস্য ছন্দ অব্যাহত ছিল এই বছরও। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের আঞ্চলিক লড়াইয়ে পয়েন্ট তালিকায় সবার ওপরে ছিল স্কালোনির দল। এ বছর সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনা ম্যাচ খেলেছে ৯টি। এর মধ্যে জিতেছে ৭টিতে, ১টি করে ড্র ও হার। এই ৯ ম্যাচে আর্জেন্টিনা গোল করেছে ১৯টি, বিপরীতে হজম করেছে মাত্র ৩টি, যা আর্জেন্টিনার আক্রমণ ও রক্ষণের শক্তিমত্তারই জানান দিচ্ছে।

মেসিই এখনো আর্জেন্টিনার সেরা ফুটবলার

এ বছর আর্জেন্টিনার ১–০ গোলের একমাত্র হারটা এসেছে ইকুয়েডরের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে। আর ১–১ গোলে ড্র করেছে কলম্বিয়ার বিপক্ষে। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় জয়টি এসেছে মায়ামিতে পুয়ের্তো রিকোর বিপক্ষে, ব্যবধান ছিল ৬–০। তবে ২০২৫ সাল বললে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সবার আগে মনে পড়বে ব্রাজিলের বিপক্ষে বুয়েনস এইরেসের ম্যাচটির কথা। যে ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে ৪–১ গোলে বিধ্বস্ত করে তারা।

পরিসংখ্যান সরিয়ে রাখলে এই সময়ে আর্জেন্টিনা দল হিসেবে আরও সংগঠিত ও সুদৃঢ় হয়েছে। মেসিকে ছাড়াও দল হিসেবে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করেছে তারা। যেমন ব্রাজিলের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জেতা ম্যাচে চোটের কারণে খেলতে পারেননি মেসি। এই ম্যাচে মেসির অনুপস্থিতির প্রভাব বুঝতে দেননি বাকিরা। পাশাপাশি হুলিয়ান আলভারেজ, থিয়াগো আলমাদা, এনজো ফার্নান্দেজ এবং অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টাররা এই সময়ের মধ্যে আরও পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে এই দশকটাকে কেউ চাইলে আর্জেন্টিনা ও লিওনেল মেসির দশক হিসেবেও মনে রাখতে পারে।

সে সঙ্গে ফ্রাঙ্কো মাস্তাতুয়োনো, নিকো পাজ কিংবা হোয়াকিন পেনিচেলির মতো তরুণদের আবির্ভাবও দেখেছে ফুটবল দুনিয়া। সামনের বিশ্বকাপে এই তরুণদের মধ্য থেকে নিশ্চিতভাবে কেউ কেউ সুযোগ পাবেন। গত বিশ্বকাপে ফার্নান্দেজ–আলভারেজরা নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ করেছিলেন। সামনের আসরেও নতুনদের উঠে আসা নিয়ে আশাবাদী হতেই পারেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা।

ব্রাজিলের অবস্থান আর্জেন্টিনার উল্টো দিকে। লম্বা সময় ধরে চলমান ব্যর্থতা ও হতাশার সময়টা অব্যাহত ছিল এ বছরও। এরপরও ব্রাজিলের জন্য বছরটা শেষ পর্যন্ত হতাশা ও যন্ত্রণা থেকে আশাবাদী হওয়ার দিকে যাত্রার বছর। বিশেষ করে কার্লো আনচেলত্তির হাত ধরে এখন দুঃসময় থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখছে ‘সেলেসাও’রা। এ বছর ব্রাজিল সব মিলিয়ে ১০টি ম্যাচ খেলেছে। জিতেছে ৫টিতে, ড্র করেছে ২ ম্যাচে আর হেরেছে ৩টিতে। এই ম্যাচগুলোয় ব্রাজিল গোল করেছে ১৭টি, হজম করেছে ১০টি।

কলম্বিয়ার বিপক্ষে মার্চে ২–১ গোলের জয় দিয়ে বছর শুরু করে ব্রাজিল। কিন্তু পরের ম্যাচেই আর্জেন্টিনার কাছে ৪–১ গোলের বিব্রতকর হার। সেই হারের জেরে চাকরি হারান কোচ দরিভাল জুনিয়র, দৃশ্যপটে আসেন কার্লো আনচেলত্তি। আনচেলত্তির অধীনে ব্রাজিলের শুরুটা অম্লমধুর।

ইতালিয়ান এই কোচ দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রাজিল আগের চেয়ে গোছানো, গতিময় ও ছান্দসিক ফুটবল খেলছে। কিন্তু জয়ের ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছে না। আনচেলত্তির অধীনে এখন পর্যন্ত ৮ ম্যাচ খেলে ব্রাজিল জিতেছে ৪টিতে, ২টি করে ড্র ও হার। সামনের দিনগুলোয় আনচেলত্তির চ্যালেঞ্জ মূলত দলকে ধারবাহিকতার মধ্যে নিয়ে আসার। সেটি করতে পারলে সুন্দর দিনের অপেক্ষা করতেই পারে ৫ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

ব্রাজিলের নতুন ভরসা এস্তেভাও

এই বছরটাও যথারীতি নেইমারবিহীন কাটিয়েছে ব্রাজিল। ফেরার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফেরা হয়নি তাঁর। তবে নেইমারকে নিয়ে হতাশা থাকলেও ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় আবিস্কারের নাম এস্তেভাও। ব্রাজিলের হয়ে আবির্ভাবেই আলো ছড়াচ্ছেন এই তরুণ। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই হয়ে উঠেছেন দলের ভরসা। শেষ চার ম্যাচে তাঁর কাছ থেকে এসেছে চার গোল। ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো ও রাফিনিয়াদের সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে এস্তেভাও হতে পারেন ব্রাজিলের অন্যতম ভরসা।

এস্তেভাও ছাড়াও ব্রাজিল মোটামুটি সব পজিশনের জন্য থিতু করার মতো খেলোয়াড় পেয়েছে। ব্রুনো গিমারেস, কাসেমিরো ও অ্যালেক্স সান্দ্রোর মতো তারকারা নিজেদের ছন্দ ধরে রেখে ব্রাজিলকে সহযোগিতা করছেন। দলীয় সমন্বয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের সংযোগও ক্রমেই ব্রাজিলকে আরও বেশি পরিণত করে তুলছে। এখন পরিণত হয়ে ওঠার প্রমাণটা সঠিক সময় সঠিক জায়গায় দিতে পারলেই হয়।