
যদি ক্রিকেটপ্রেমী পাঠক হন, কিংবা দর্শক, সৌম্য সরকারের কথাটা শুনে আপনি চমকে যেতে পারেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবারও কোনো পঞ্চপাণ্ডব আসুক, এটা চান না সৌম্য!
এ কেমন কথা! এ দেশের ক্রিকেটে পঞ্চপাণ্ডব কারা, সেটা তো ক্রিকেটপ্রেমীরা জানেনই। তবু নামগুলো আবার স্মরণ করিয়ে দিই—মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ। অনেক দিন বাংলাদেশ দলে অপরিহার্য হয়ে ছিলেন তাঁরা, একসঙ্গে মিলে একটা নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দেওয়া নাম ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ছড়িয়ে পড়েছে সমর্থকদের মধ্যেও। সৌম্য কি তাহলে চান না এ দেশের ক্রিকেটে এই পাঁচজনের মতো আর কেউ আসুক?
প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রর সঙ্গে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে সৌম্য নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজের কথাটার। সাক্ষাৎকার না বলে দুজনের এই কথোপকথনটাকে আড্ডা বলাই অবশ্য ভালো, যা গতকাল প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও ওয়েবসাইটে।
আরও অনেক বিষয়ের মধ্যে সেই আড্ডাতেই এসেছে পঞ্চপাণ্ডব প্রসঙ্গ। উৎপল শুভ্র বলেন, তাঁর মনে হয়েছিল সৌম্য সরকার, লিটন দাস, নাসির হোসেন, সাব্বির রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান হয়তো হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী পঞ্চপাণ্ডব। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি।
তাঁরা (পঞ্চপাণ্ডব) তো আমাদের দেশের জন্য লেজেন্ড, তাঁরা যে পারফর্ম করেছেন, এটা বাংলাদেশ কখনোই ভুলবে না। যেভাবে টিমকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন...কিন্তু ওই যে বললাম, যখন সব সময় পঞ্চপাণ্ডব বলা হতো, ছয় নাম্বার কে আছে, সাত নাম্বার কে আছে, এটার হিসাব কেউ রাখত না।সৌম্য সরকার
কেন হয়নি, সেই কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়েই সৌম্যর সহজ স্বীকারোক্তি, ‘যে কজনের নাম বললেন সবাই কিন্তু ম্যাচ উইনার। তবে হ্যাঁ, আমরা সবাই ক্লিক করতে পারিনি, প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্লিক করতে পারিনি। এটা এটা হয়তো নিজেদেরই ভুল। স্বীকার করতে হবে যে আমরা পারিনি।’
তারপরই হঠাৎ সেই চমকে দেওয়া কথাটা বলেছেন সৌম্য, ‘পরবর্তী পঞ্চপাণ্ডব হয়নি, এটাতে আমি খুশি। আমি চাইও না যে পরবর্তীতেও কেউ আর পঞ্চপাণ্ডব হোক। কোনো পাণ্ডবই না হোক।’
কিছুটা বিস্মিত উৎপল শুভ্র কারণ জানতে চাইলে সৌম্য ব্যাখ্যা করেন, ‘কারণ এতে টিমের ভেতরে ভাগ হয়ে যায়। আপনি মনে করছেন, পাঁচজন প্রপার আছে, কিন্তু সেই পাঁচজন তো একা খেলছে না। বাকি ৬ জন আছে ১১ জনে। কিন্তু ওরা ঢাকা পড়ে যায়। মানে, ওই পাঁচজনের বাইরে যদি কেউ ৩০ রানও করত, সেই ৩০ রানের কোনো মূল্য থাকত না। তাই আমি চাইও না যে আর কেউ এ রকম হোক।’
মেসি গোল করে। কিন্তু মেসির গোল করতে গেলে তো এর আগে ৫টা পাস দিয়ে, ১০টা পাস দিয়ে আসা লাগে। তো আমাদের টিমেও যদি ওই পাঁচজনের পারফর্ম করতে গেলে বাকি ছয়জনের কিছু করা লাগত। তারপর আসলে ওরা পারফর্ম করত।সৌম্য সরকার
উৎপল শুভ্র এবার নিজের যুক্তি দেখিয়ে বলেন, অনেক দলেই এ রকম হয়। একসময় যেমন ভারত দলে শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়, বীরেন্দর শেবাগ, ভিভিএস লক্ষণরা ছিলেন, যাঁদেরকে অন্যদের চেয়ে তো তাঁদের একটু আলাদাই মনে করা হতো। আবার রোনালদো কিংবা মেসিরাও তো নিজের দলে সবার চেয়ে আলাদা মনোযোগ পান। এটা শুনে সৌম্যর পাল্টা যুক্তি, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই মেসি গোল করে। কিন্তু মেসির গোল করতে গেলে তো এর আগে ৫টা পাস দিয়ে, ১০টা পাস দিয়ে আসা লাগে। তো আমাদের টিমেও যদি ওই পাঁচজনের পারফর্ম করতে গেলে বাকি ছয়জনের কিছু করা লাগত। তারপর আসলে ওরা পারফর্ম করত।’
এ পর্যায়ে উৎপল শুভ্র জানতে চান, সাধারণ মানুষ ও মিডিয়ার ওই পাঁচজনের দিকে বেশি মনোযোগের কারণেই অন্যরা নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি, সৌম্য এমন মনে করেন কি না।
উত্তরে সৌম্যর কথা, ‘অবশ্যই। যেকোনো কিছু করলেই কিন্তু নাম আসত তাদেরই।’
তারপর উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ধরুন, আমরা এখন পর্যন্ত একটাই ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতেছি (সঙ্গে সঙ্গে উৎপল শুভ্র স্মৃতিচারণা করেন, ২০১৯ সালে বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে সেই সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন সৌম্য সরকার)। আমার সঙ্গে সেই সিরিজে মোসাদ্দেকও ভালো খেলেছিল। কিন্তু আমাদের কোনো নাম হয়নি। আমি বলছি না আমাদেরই নাম হতে হবে। পারফর্ম করা সব প্লেয়ারেরই কাজ। কিন্তু ওই সময় কিন্তু মিডিয়া কোনো ক্রেডিট আমাদের দুজনকে দেয়নি। এ রকম ছোট ছোট কিছু কিছু থাকে। আমি এ জন্যই বলছি যে আপনি যখন কাউকে বড় বড় করে দেখাবেন, তখন আরেকজনের পারফরম্যান্সটা ঢাকা পড়ে যায়।’
এটুকু বলে অবশ্য সৌম্য আবার যোগ করেন, ‘তাঁরা (পঞ্চপাণ্ডব) তো আমাদের দেশের জন্য লেজেন্ড, তাঁরা যে পারফর্ম করেছেন, এটা বাংলাদেশ কখনোই ভুলবে না। যেভাবে টিমকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন...কিন্তু ওই যে বললাম, যখন সব সময় পঞ্চপাণ্ডব বলা হতো, ছয় নাম্বার কে আছে, সাত নাম্বার কে আছে, এটার হিসাব কেউ রাখত না।’
নিজের কথার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সৌম্য উদাহরণ টেনেছেন মোস্তাফিজুর রহমানের। দাবি করেছেন, মোস্তাফিজের যতটুকু আলোতে থাকার কথা, ততটা থাকেননি। উৎপল শুভ্র অবশ্য তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন, মোস্তাফিজ অবশ্যই হাইলাইটেড হয়েছেন এবং তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুপারস্টারও। সৌম্য আবারও যুক্তি দেন, ‘ও মিডিয়ার সঙ্গে থাকে না, এটা হয়তো বা তার একটা বড় ব্যর্থতা। সে যদি মিডিয়ার সঙ্গে থাকত, আমার কাছে মনে হয়, তার ইয়েটা (তাঁকে নিয়ে আলোচনা) আরও অনেক বেশি থাকত।’