
ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলের মঞ্চে তখন ঝলমলে আলো। চারপাশে করতালির ঢেউ, ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এক চেনা মুখ। সময় যাঁর শরীরের ফেলেছে বয়সের ছাপ। কিন্তু চোখে এখনো সেই পুরোনো দীপ্তি। মঞ্চে উঠলেন মোশাররফ হোসেন শামীম। বাংলাদেশের সাবেক দ্রুততম মানব, যাঁর নামের পাশে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ও জ্বলজ্বল করছে। সময়ের স্রোত পেরিয়ে এই পড়ন্ত বিকেলে দাঁড়ালেন নিজেরই জীবনের সম্মাননা স্মারক নিতে।
‘সিটি গ্রুপ-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার ২০২৪’-এর আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়ে শামীমের কণ্ঠে ছিল আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার মিশেল। দেশের অ্যাথলেটিকসে অনন্য অবদান রাখার এই স্বীকৃতি তাঁকে যেন উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন। পরিবার, শুভানুধ্যায়ী, খেলোয়াড় বন্ধুদের।
স্মরণীয় মুহূর্তে স্মরণ করলেন জীবনের এক বিশেষ মানুষকে। অনুষ্ঠান শেষে তাঁর কণ্ঠে প্রয়াত মামার প্রতি শ্রদ্ধা, ‘পুরস্কারটি উৎসর্গ করছি আমার মামা মইনুল আহসান সিদ্দিকীকে। চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে প্রথম ১০০ ও ২০০ মিটার জয়ের পর তিনি আমাকে মিষ্টি খাইয়ে বলেছিলেন—তুমি পারবে।’
পেরেছেন মোশাররফ হোসেন শামীম। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১—টানা সাতবার দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার গল্প শুধু গতির নয়। এটি অনমনীয় ইচ্ছাশক্তিরও ইতিহাস। চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের এক কিশোর, যাঁর প্রথম প্রেম ছিল ফুটবল। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথমে খেললেন ফুটবল। কিন্তু ভাগ্যের বাঁক তাঁকে নিয়ে গেল অন্য পথে—অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে।
১৯৭৩ সালের চট্টগ্রাম জেলা অ্যাথলেটিকসে প্রথম দেখা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দ্রুততম মানব খাদেম হোসেনের সঙ্গে। সেখান থেকেই শুরু ট্র্যাকের গল্প। দুই বছর পর ১৯৭৫ সালে খাদেমকে হারিয়ে মোশাররফ হোসেন শামীম জানিয়ে দিলেন, দেশের দ্রুততম মানবের সিংহাসনে নতুন নাম উঠছে। সেদিনের সেই জয় ছিল এক ঘোষণার মতো, যার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ট্র্যাকজুড়ে বইতে লাগল তাঁর পায়ের গতির ঝড়। তবে যাঁকে হারিয়ে নিজের যাত্রা শুরু, সেই খাদেমকেই তিনি মানেন দেশের সেরা।
১৯৭৭ সালে বুলগেরিয়ায় বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় গেমস, কানাডায় কমনওয়েলথ গেমস, ১৯৭৮ সালে ব্যাংককের এশিয়ান গেমসে খেলেছেন শামীম। ১৯৮০ সালে তুরস্কে বিশ্ব ইসলামিক গেমসে ১০০ মিটারের ফাইনালে ওঠেন। তাঁর গতি ছড়িয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চেও।
কিন্তু এর আগেও তাঁর জীবনে ছিল এক অন্য দৌড়। মুক্তির দৌড়। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল গভীরভাবে। মোশাররফ হোসেন শামীম তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ২৬ মার্চের পর বাবার ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নির্মমতা দেখে চুপচাপ পা বাড়ালেন সীমান্তের পথে। ভারতীয় সেনাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অংশ নিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
২০০৭ সালে ১৪ মাসের জন্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু সাংগঠনিক শূন্যতা, সার্ভিসেস দলগুলোর বিলুপ্তি তাঁকে ব্যথিত করেছিল। অনেক সমস্যার মধ্যেই চেষ্টা করেছেন দেশের ঘুণে ধরা অ্যাথলেটিকসকে টেনে তুলে দাঁড় করাতে। কতটা পেরেছেন, সেই হিসাব কষতে বসলে আক্ষেপই করেন বেশি। তবে খেলোয়াড়দের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল বরাবরই।
সবকিছু এত সুন্দর হয়েছে যে আমি ভীষণ আনন্দিত। এ যেন আমার জীবনে আলোকিত আরেকটি বিকেল।মোশাররফ হোসেন শামীম
অনেক দিন ধরে অসুস্থতার কারণে ছিলেন আড়ালে। মঞ্চের করতালি আর আলো থেকে দূরে। কিন্তু আজ সেই নীরবতা ভেঙে আবার ফিরে এলেন আলোয়। মঞ্চে নিজের ওপর প্রামাণ্যচিত্র দেখে অভিভূত তিনি, ‘সবকিছু এত সুন্দর হয়েছে যে আমি ভীষণ আনন্দিত। এ যেন আমার জীবনে আলোকিত আরেকটি বিকেল।’ স্বীকার করলেন, জীবনের শেষ সময়ে এই সম্মান পাওয়া তাঁর কাছে বিরাট অর্জনও। বিশেষ করে অ্যাথলেটিকসে পুরুষ স্প্রিন্টারদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই স্বীকৃতি পেলেন।
অনুষ্ঠান শেষে অনেকটা সময় অনেকের অভিনন্দনে সিক্ত হলেন মোশাররফ হোসেন শামীম। স্ত্রী, ছেলে, নাতি-নাতনি আর আত্মীয়দের নিয়ে ধীরে ধীরে অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মুখে তৃপ্তির হাসি। মনে স্মৃতির আলো। দীর্ঘ পথচলার শেষ প্রান্তে এসেও আবার ছুঁয়ে দেখলেন জয়ের আনন্দ। এই আনন্দই বাকি জীবনে তাঁর কাছে গর্বের অনুভূতি হয়ে থাকবে, নিজেই তা বলে যান বাড়ি ফেরার আগে।
দ্রুততম মানবের আড়াল থেকে ফেরা হলো আরেকবার। আলোর মঞ্চে, করতালির শব্দে, ভালোবাসার উষ্ণতায়।