যখন দৌড়াতেন, মনে হতো যেন হাওয়ায় ভাসছেন। পায়ের নিচে মাটি নেই, তিনি শুধুই উড়ছেন। এই উড়ন্ত রূপ দেখেই ভালোবেসে সবাই তাঁর নাম দিয়েছিল ‘ফ্লাইং শিখ’। হাওয়ার বেগে ছুটে চলা সেই শিখ শুধু প্রতিপক্ষকেই পেছনে ফেলেননি; বরং পেছনে ফেলেছেন জীবনের পথে আসা সব বাধাকেও। যেন জীবনের পথে পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো খড়কুটোকেও ফেলে এগিয়ে গেছেন।
যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি হলেন ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণিল চরিত্রগুলোর একজন—কিংবদন্তি অ্যাথলেট মিলখা সিং। এশিয়ান গেমস ও কমনওয়েলথ গেমসের ৪০০ মিটার দৌড়ে সোনা জেতা একমাত্র ভারতীয়। ১৯৫৮ টোকিও এশিয়ান গেমসে ২০০ ও ৪০০ মিটারে সোনা জেতার পর ১৯৬২ জাকার্তা গেমসে সোনা জেতেন ৪০০ মিটার ও ৪x৪০০ মিটার রিলেতে। ৪০০ মিটার জিতেছিলেন ১৯৫৮ কার্ডিফ কমনওয়েলথ গেমসেও।
কিন্তু দৌড়ের ট্র্যাকের মতো মিলখার জীবনের পথটা মসৃণ ছিল না। কঠোর সংগ্রাম আর অদম্য পরিশ্রমের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাফল্য ধরা দিয়েছে তাঁর পায়ে। তবে সেই সাফল্যও সব সময় স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি তাঁর জীবনে বারবার সত্যি হয়েছে, ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু হারতে পারে না।’
এই উত্থান-পতনের অসাধারণ গল্প নিয়েই পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা নির্মাণ করেছিলেন ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি শুধুই একটি সিনেমা নয়, সংগ্রাম আর গভীর নিষ্ঠার এক অসাধারণ গল্প।
এ ছবির প্রাণ কেন্দ্রীয় চরিত্রে ফারহান আখতারের অভিনয়। এতটাই সাবলীল ছিলেন তিনি, মনে হয়েছে বাস্তবের মিলখা সিং যেন পর্দায় জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। এই চরিত্রের জন্য তাঁর নিবেদনও ছিল অনবদ্য। এক সাক্ষাৎকারে ফারহান বলেছেন, এই চরিত্রের জন্য নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়ার পেছনে আসল মিলখা সিংয়ের একটি কথাই তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। মিলখা তাঁকে বলেছিলেন, ‘যদি তুমি কোনো কিছুতে ভালো করতে চাও, তবে সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হবে।’
এ কথা ফারহানকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করে তোলে। এ ছবির জন্য তিনি ১৩-১৪ মাস ধরে একজন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পেশি বাড়াতে তিনি প্রায় ১০ কেজি ওজন বাড়িয়েছিলেন। নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্যে পেশির রেখা স্পষ্ট করার জন্য টানা পাঁচ দিন তাঁকে শুধু তরল খাবার খেতে হয়েছিল। এ ছাড়া শারীরিক সহনশক্তি বাড়াতে লাদাখের মতো উঁচু জায়গায় বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। আবার মিলখা সিংয়ের তরুণ বয়সের চেহারা ফুটিয়ে তোলার জন্য উল্টো ১৪ কেজির বেশি ওজন কমাতে হয়েছিল তাঁকে।
এর ফলও পরবর্তী সময়ে ফারহান পেয়েছিলেন। এ ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য একই সঙ্গে ফিল্মফেয়ার ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন তিনি। শুধু ফারহানই নন, ছবিতে তাঁর বোন ‘ইসরি কৌর’-এর চরিত্রে দিব্যা দত্তের অভিনয়ও ছিল দুর্দান্ত।
ছবিটির আবেগ দর্শকদের মনে ছড়িয়ে দিতে দারুণ ভূমিকা রেখেছে এর সংগীত। শঙ্কর-এহসান-লয়ের সুরে পাওয়া গেছে অনুপ্রেরণা, আবেগ আর মেলোডির সুন্দর মিশ্রণ। সিনেমাটোগ্রাফিও ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে দৌড়ের দৃশ্যগুলো এমনভাবে ধরা হয়েছে যে দর্শক যেন স্টেডিয়ামের ভেতরেই বসে আছেন।
তবে ছবির কিছু দুর্বল দিকও আছে। তিন ঘণ্টার বেশি সময়ের ছবিটি কিছু জায়গায় খেই হারিয়েছে, তৈরি করেছে বিরক্তি। এডিটিং ভালো হলে দৈর্ঘ্য কমিয়ে ছবিটিকে আরও টান টান করা যেত। প্রতিযোগিতার বাইরের দৃশ্যগুলোতেও উত্তেজনার ঘাটতি ছিল। কিছু জায়গায় অতিরিক্ত নাটকীয়তা যুক্ত করায় ছবির আবেদন কিছুটা কমেছে।
তারপরও ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ নিছক বিনোদনের ছবি নয়। এটি সংগ্রাম, পরিশ্রম আর অনুপ্রেরণার এক অসাধারণ গল্প। যেখানে জীবনের বাধা যেমন জয় করেছেন মিলখা সিং, তেমনি পর্দায় দর্শকের মন জয় করেছেন ফারহান আখতার।
পরিচালক: রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরাঅভিনয়: ফারহান আখতার, দিব্যা দত্ত, সোনম কাপুর, প্রকাশ রাজ, পবন মালহোত্রা ও রেবেক ব্রিডস।আইএমডিবি রেটিং: ৮.২/১০রানটাইম: ৩ ঘণ্টা ৬ মিনিট