মরুভূমিতে 'থরহরি' কম্প

উটের পিঠে মরুযাত্রা। ছবি: সঞ্জীব চক্রবর্তী
উটের পিঠে মরুযাত্রা। ছবি: সঞ্জীব চক্রবর্তী

থর মরুভূমিতে সেদিন বেমক্কা ঝড় উঠেছিল। ভারতে রাজস্থানের জয়সলমিরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই থর মরুভূমি। মাইলের পর মাইল সোনারঙা ঢেউখেলানো বালুর রাজ্য। ধু ধু প্রান্তরে ধূসর কাঁটা ঝোপ আর বুনো উট। মরুভূমিতে অভিযান হবে, তাই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জয়সলমির এসেছি। অনেক দর-কষাকষির পর সেলিম খানের উটের সওয়ারি হয়ে বসলাম। উট দুলকি চালে বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি ডিঙিয়ে যায়। তপ্ত রোদে পোড়া ঘাসগুলোকে সিংহের কেশরের মতো দেখাতে থাকে। এমন সময় কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই বালুর ঘূর্ণি ওঠে মরুভূমিতে। শোঁ শোঁ বাতাসের সঙ্গে উষ্ণ বালু এসে আছড়ে পড়ে গায়ে, মাথায়। এবার উট ঝড়ের গতিতে ছোটে। পেছন থেকে বালুর ঢেউ আছড়ে পড়ে ছুটন্ত উটের পায়ে। ঝাঁকড়া এক বাবলাগাছের আড়ালে গিয়ে সেলিম খান আর তাঁর উট খানিকটা নিরাপদ বোধ করে। মরুঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের হূৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। ঝড় থামার অপেক্ষা শুরু হয়। সেলিম খান অভয় দিতে থাকেন, ‘ডরিয়ে মাত বাবু, ইয়ে হররোজ কা মামলা হ্যায়।’ তাঁকে বুঝিয়ে বলি, ঝড়-জলের দেশের মানুষ আমরা, এ শুকনো মরুঝড় ভয় উদ্রেককারী হলেও মন্দ লাগে না।

বাতাসের গতি পড়ে গেলে সানসেট পয়েন্টের নির্দিষ্ট পথ ধরে পুনর্যাত্রা শুরু হয়। সানসেট পয়েন্ট উঁচু এক বালিয়াড়ি। এখানে পর্যটকেরা মরুসূর্য কেমন করে অস্তমিত হয়, সেই দৃশ্য দেখার জন্য ভিড় করেন। আমরা মরুঝড়ে দলছুট হয়ে খানিকটা পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই এবার গতি বাড়াতে হয়। সেলিম খান এবার মওকা বুঝে তাঁর সেলামিও বাড়িয়ে নিতে চান। সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখেছি, মরুসূর্য কেমন করে বালুর সমুদ্রে হারিয়ে যায়, সে তো দেখতেই হবে। অগত্যা সেলিম খানের প্রস্তাবেই রাজি হতে হয়। উটকে এবার তিনি দ্রুত দাবড়িয়ে নিয়ে সূর্যাস্তের আগেই বালিয়াড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। এখানে তখন সারি সারি উটের কাফেলা। পশ্চিম আকাশের মস্ত থালার মতো সূর্যের দিকে সবাই মুখ করে আছে। আকাশ এবার আস্তে-ধীরে রং পাল্টাতে শুরু করে। মেঘহীন মরু আকাশে সূর্য তার সব রং নিয়ে যেন হোলি উৎসব শুরু করে। অভিযাত্রীদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে একসময় টুপ করে সূর্যটা ডুবে যায় দূর মরুপ্রান্তরে।

রাতে মরুভূমিতে ঐতিহ্যবাহী নাচ

মরুভূমিতে রাত তাড়াতাড়ি নামে। তাই ঝুপ করে আঁধারে ঢেকে যায় চারপাশ। ফিরতি গন্তব্য তাঁবু। রাত কাটানোর জন্য মরুভূমিতে অনেক জায়গাজুড়ে তাঁবু খাটানো হয়েছে। আধুনিক সব সুবিধাই এখানে প্রস্তুত। তাঁবু এলাকায় ঢোকার মুখেই রাজস্থানের পোশাকধারী নর-নারী তাঁদের নিজস্ব ঢঙে বরণ করেন অতিথিদের। এখানে পূর্ণচন্দ্রের মতো গোল করে ঘেরা তাঁবুর পর তাঁবু, মাঝখানে মস্ত উঠান। উঠান ঘিরে রাজসিক তাকিয়া রাখা। গদাই লস্করি চালে পাশবালিশে হেলান দিয়ে জমিয়ে বসি। একপাশে বৈঠকি ঢঙে রাজস্থানি বাদ্য বাজাতে থাকেন দক্ষ বাদক। বাজনার তালে তালে তাঁদের দেহ দুলতে থাকে মরুভূমির র‌্যাটল স্নেকের মতো। ঘোষক এবার গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আব দেখিয়ে না, হাম লোগোকি ট্র্যাডিশনাল কালভেলিস নৃত্যা।’ শুরু হলো ভয় ধরানো আর বিস্ময়মাখা অদ্ভুত এক নাচ। আগুনের মধ্যে দিব্যি নেচে গেলেন তাঁরা। মাথায় সাতটা হাঁড়ি চাপিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে নেচে-গেয়ে অতিথিদের মন মাতালেন। নটরাজ হয়ে ভাঙা কাচের ওপর তাণ্ডব দেখালেন নৃত্যের ভঙ্গিতে। কালভেলিস নৃত্য শেষে শুরু হলো রাজস্থানি গান। নেশা ধরানো অচেনা ভাষার অদ্ভুত সেই গান। মধ্যরাত উতরে গেছে অনেকক্ষণ। গানের সুরে রাত বাড়তে থাকে। সুনসান মরুভূমিতে বিচিত্র সেই গান সেদিন বড় ভালো লাগে।

যেভাবে যাবেন

মরুভূমি

কলকাতা থেকে জয়সলমিরগামী ট্রেন ধরতে পারেন। কমবেশি ৩৮ থেকে ৪০ ঘণ্টা লাগবে পৌঁছাতে। ভাঙা পথে দিল্লি হয়েও যাওয়া যায়। এতে কষ্ট কম হবে। জয়সলমিরে প্রতিটি হোটেলই আছে মরুভূমি অভিযানের প্যাকেজ। এই প্যাকেজ দুই ধরনের। রাতে মরুভূমিতে থাকতে চাইলে এক রকম খরচ, না চাইলে অন্য। উটের সওয়ারি হতে চাইলে গুনতে হবে কিন্তু আলাদা অর্থ।