
সালমা, রেশমা, কণা, বিউটি, রুমারা থাকে আগারগাঁওয়ের কুমিল্লা বস্তিতে। তাদের বয়স ৭ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এবং সবারই প্রিয় খেলা বউচি। শীতের পড়ন্ত বেলায় আকাশ যখন বিভিন্ন রঙে তার ঘর সাজাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তাদের। জানতে চাই, কেমন গেল ২০১৩ সাল। উত্তর বস্তির এই মেয়েশিশুরা জানায় নানা কথা।
বউচি খেলার সময় রুমা সব সময়ই ‘বউ’ হতো। প্রতিপক্ষ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কীভাবে ‘বাপের বাড়ি’ যেতে হবে, সে বিষয়ে তার জুড়ি নেই। কিন্তু রুমা এখন খেলায় অংশগ্রহণ করে না, তবে মাঝেমধ্যে দর্শক হিসেবে খেলাটা উপভোগ করে তিন মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে। রুমার বয়স এখন ১৪ বছর আট মাস (জন্মসনদ অনুযায়ী)। অল্প বয়সে মা হওয়ায় তার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছে। শুধু রুমা নয়, কুমিল্লা বস্তিসহ অনেক বস্তির অনেক মেয়েশিশুই গত বছর মা হয়েছে। অনেক মেয়েশিশুর বিয়ে হয়েছে। তাদের অনেকে ভালো থাকলেও কেউ কেউ ইতিমধ্যে স্বামীর ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
নানা সমস্যায় বস্তির মেয়েশিশুরা জর্জরিত থাকলেও বিদ্যালয়গামী মেয়েশিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বনানীর কড়াইল বস্তির শিউলি, লিজা, আসমা, কলি, রুমিনা সবাই বিদ্যালয়ে যায়। গত বছরই তারা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এ বস্তিতে ঘুরে দেখা যায়, অন্য বস্তির তুলনায় বস্তিটি একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং এখানকার অধিকাংশ মেয়েশিশুই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এর কারণ হিসেবে রুমিনার মা বলেন, ‘ইশকুল তন মাইয়্যাকে ট্যাকা দেয়, খাওন দেয়, তাইলে ইশকুলে পাডামু না ক্যান।’ তবে দৈনন্দিন জিনিসের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর কত দিন মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারবেন, সে বিষয়ে সংশয়ে আছেন তিনি। মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সম্পর্ক কী জানতে চাইলে বলেন, ‘তহন মাইয়্যাকে বাসায় কামে দিমু।’ তবে শিক্ষার প্রয়োজনীতার কথা জানেন তিনি।
শিউলি, লিজা ও আসমা স্কুলে পড়লেও একই বস্তির কুলসুম (১৪) গত বছর পড়ালেখার ইতি টেনেছে। সে এখন দুটি বাসায় পরিচারিকার কাজ করে। কুলসুম বলে, ‘স্কুলে গিয়া লাভ কী? ওই সময় দুইডা বাসায় কাম করলে অনেক বেশি ট্যাকা পাওন যায়। ট্যাকা সংসারের কামে লাগে।’
কুলসুমের মতো শরিফাও (১৫) পড়ালেখা বাদ দিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছে। কিন্তু কয়েক দিন সেখানে কাজ করতে পারবে, তা বলতে পারে না। কারণ, এরই মধ্যে সহকর্মীরা তাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে দিয়েছে।
এ ছাড়া বস্তিতে বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে। তাদের যন্ত্রণায় মেয়েশিশুরা অস্থির। রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানসংলগ্ন বস্তির রওশনা বেগম বলেন, ‘পোলাগো লাই ঘরে মাইয়্যা রাওন যাইত নো। মাইয়্যা দেখলেই শিস মারে, খারাপ কতা কয়।’ এ ছাড়া বস্তিগুলোতেও হঠাৎ নেশা, আড্ডা এবং অপরিচিত মানুষের সমাগম বেড়েছে বলে জানান রওশনা বেগম, যা নিয়ে অনেক মেয়েদের অভিভাবকেরা শঙ্কিত।
বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হলেও বস্তিবাসীর, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের জীবনযাত্রায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। বরং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ঘরভাড়াও বেড়ে গেছে। ফলে, মা-বাবা মেয়েশিশুদের পেছনে আগের চেয়ে আরও কম টাকা খরচ করেন। এ ছাড়া খাবারে ছেলে ও মেয়েশিশুদের মধ্যে ভীষণ বৈষম্য বলে জানিয়েছে বিভিন্ন বস্তির মেয়েরা। তেজগাঁও রেললাইন বস্তির লিমা বলে, ‘মায় ভাইরে বেশি খাওন দেয়। ভালো তরকারিও ওরে দেয়।’ এ বিষয়ে লিমার মা বলেন, ‘মাইয়্যা মাইনষের অনেক কিছু সওয়া লাগে আর মাইয়্যাগো কম খাওনই ভালা।’
বস্তিতে প্রতিটি ঘরে টেলিভিশন না থাকলেও কেব্ল সংযোগ এবং মুঠোফোনের প্রভাবে মেয়েদের চিন্তা-চেতনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। যদিও বিষয়টি অভিভাবকেরা ভালো চোখে দেখছেন না। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত, তবে সচেতন নয়। আবার কেউ কেউ সচেতন হলেও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার কারণে তারা তাদের সচেতনতাকে কাজে লাগানোর তেমন সুযোগ পায় না।
বয়োঃসন্ধিকাল প্রতিটি মেয়ের জন্য স্পর্শকাতর একটি সময়। এ সময় মেয়েদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। মানসিকভাবেও সহযোগিতা দরকার। কিন্তু এ ধরনের কোনো সাহায্য বস্তির মেয়েশিশুরা পায় না। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাব আরেকটি বড় সমস্যা। মোহাম্মদপুরের বরকতের বস্তিতে প্রায় ১৭০টি পরিবারের বসবাস। কিন্তু টয়লেটের সংখ্যা মাত্র দুই। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে মেয়েশিশুরা। এর ফলে তারা কিডনি রোগসহ নানা রোগে ভোগে।