গ্রামীণফোন-প্রথম আলো আই-জিনিয়াস ২০১২

রাইসার রশ্মি

সীলমা সুবাহ রাইসা: আই-জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার ২০১২ ছবি: কবির হোসেন
সীলমা সুবাহ রাইসা: আই-জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার ২০১২ ছবি: কবির হোসেন

শেষ প্রশ্নটি ছিল স্টিভ জবসের প্রথম চাকরি কোথায়—তা জানতে চেয়ে। ৯০ সেকেন্ড সময় শেষ হতে চলেছে। রাইসার উত্তরের পর পিনপতন নীরবতা। ‘আই জেন রোবট’ যখন উত্তরটি সঠিক বলে ঘোষণা দিল, সঙ্গে সঙ্গেই পুরো মিলনায়তন ফেটে পড়ল তুমুল করতালিতে। মঞ্চে দাঁড়ানো মানুষটি তখনো মনে হয় বিশ্বাস করতে পারছিল না, এক মুহূর্ত আগেই সে জিতে নিয়েছে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ইন্টারনেট উত্সব ২০১২-এর ‘আই-জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার’ খেতাব।
কক্সবাজারের মেয়ে সীলমা সুবাহ্ রাইসা নির্বাচিত হয়েছে এবারের আই-জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার। এ দেশের মেয়েরা নাকি তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে ছেলেদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। কথাটিকে সর্বতোভাবে মিথ্যা প্রমাণ করে সারা দেশের পাঁচ লাখ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে আই-জিনিয়াসের খেতাবটি মেধা আর যোগ্যতার বলে জিতে নেয় রাইসা। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় উঠে আসা সারা দেশের ১২১ জন প্রতিযোগীর মধ্যে মেয়ে ছিল মাত্র ১১ জন। তাদের মধ্য থেকেই চ্যাম্পিয়ন হয় রাইসা।
চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া রাইসার বসবাস সাগরের কোলঘেঁষা কক্সবাজারের প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্যের মধ্যে। কিছুদিন আগেই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়েছে সে, ভর্তি হয়েছে কক্সবাজার সরকারি কলেজে। পড়াশোনায় সব সময় দারুণ মনোযোগী রাইসা সব সময়ই মেধার প্রমাণ দিয়ে এসেছে বিভিন্ন পরীক্ষায়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি আর এসএসসিতে জিপিএ-৫ তারই প্রমাণ। তবে শুধু পড়াশোনাতেই তার আগ্রহ সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছবি আঁকা, লেখালেখি, গান গাওয়া এমন আরও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রাইসার আছে সরব উপস্থিতি। ছবি এঁকে জেলা পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়ার গৌরবও আছে তার।
এর আগের বারও আই-জিনিয়াস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল রাইসা। কিন্তু কক্সবাজার রাউন্ডে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ে যায়। তাই এবার যেন আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল সে। রাইসা জানায়, ‘আমার শখ ইন্টারনেট ব্রাউজ করা। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ইন্টারনেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। খুব অবাক লাগে যখন দেখি কীভাবে একটা যন্ত্রের মাধ্যমে বাসায় বসে আমি পুরো পৃথিবীর খবরাখবর জেনে যেতে পারছি।’
রাইসার কথারই যেন প্রতিফলন ছিল এবারের গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ইন্টারনেট উত্সবে। ‘এসো পৃথিবীর পাঠশালায়’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে দ্বিতীয়বারের মতো দেশব্যাপী স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় উত্সব। সারা দেশের আনাচকানাচ তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা, ইন্টারনেটের অফুরন্ত তথ্যভান্ডারকে উন্মোচিত করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। রাইসার আই-জিনিয়াস নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য যেন অনেকটাই আজ সফল।

বিজয়ের পর বন্ধুদের অভিবাদনে সিক্ত সীলমা সুবাহ রাইসা। ছবি: সাজিদ হোসেন

বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের জন্য রাইসা প্রথম থেকেই ইন্টারনেটকে ব্যবহার করছে বইপত্রের সহযোগী হিসেবে। ‘প্রথম প্রথম শুধু ফেসবুক অথবা ই-মেইলের মতো যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেই সময় কাটাতাম। দেশি-বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোই লাগত। তারপর একসময় বুঝতে পারলাম ইন্টারনেটের বিশাল তথ্যভান্ডার আমাকে আরও অনেকভাবে সহায়তা করতে পারে। কিছু একটা জানার দরকার বা ইচ্ছা হলেই নেট খুলে বসে যেতাম উইকিপিডিয়া, ইয়াহু অথবা গুগলে। এভাবেই ইন্টারনেটের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে।’ বলল রাইসা।
ভবিষ্যতে চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্ন দেখে মেধাবী মেয়েটি। পুরো পরিবারই যুক্ত আছে চিকিত্সা পেশার সঙ্গে। বাবা ডা. জি এম কাদেরী বিশিষ্ট চক্ষুবিশেষজ্ঞ, মা ডা. নাজিমা আক্তার প্রসূতিবিদ্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কক্সবাজারে কর্মরত আছেন। একমাত্র ভাই মুশনাদ কাদেরী পড়াশোনা করছেন ঢাকার ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষে। ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়ে রাইসা বলে, ‘মানুষের রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সায় আজকাল প্রযুক্তি যেমন করে কাজে লাগছে, তা অভাবনীয়। আমাদের দেশের চিকিত্সা খাতকে আরও প্রযুক্তিবান্ধব করার লক্ষ্যে ভবিষ্যতে কাজ করতে চাই আমি।’
তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও গতিশীল দেখতে চায় রাইসা। ‘আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মূলত সামাজিক যোগাযোগের সাইট ব্যবহার করে। অথচ আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য তো জানা যায়ই, এমনকি আউটসোর্সিংয়ের মতো কাজের মাধ্যমে ঘরে বসেই আয় করা সম্ভব। এ দিকেও সবার দৃষ্টি দেওয়া দরকার’
স্প্রেড দ্য লাইট-এর যে স্লোগানকে সামনে রেখে চলছে আই-জিনিয়াস কার্যক্রম, তা বাস্তবায়নে কাজ করতে চায় রাইসা। বিশেষ করে মেয়েদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি বিরাট বিপ্লব সাধন করতে পারে বলে বিশ্বাস রাইসার। এখনকার যুগটাই হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির। যে যত তথ্য জানবে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। মেয়েরা যে ছেলেদের থেকে আজকাল কোনো অংশেই কম নয়, তার প্রমাণ সব পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল। ৫০ শতাংশ অথবা ৫০ শতাংশের বেশি অবস্থান রেখে মেয়েরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, তারাও পারে। ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করবে বলে আশাবাদী আই-জিনিয়াস রাইসা।
চ্যাম্পিয়ন রাইসা কিছুদিন পরই যাত্রা করবে নরওয়ের উদ্দেশে মাসব্যাপী প্রযুক্তি শিক্ষাকার্যক্রমে। প্রত্যয়ী রাইসা স্বপ্ন দেখে নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন একটি সমাজের। একদিন নিজ নিজ মেধা দিয়েই সব জায়গায় নিজের জয়গান গাইবে মেয়েরা, এমনটাই বিশ্বাস তার। জয়তু রাইসা!