সংস্কৃতি সংকট
প্রশ্ন উঠেছে, একদল লোক আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে, পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তারা এই ধ্বংসের বীজ ছড়াচ্ছে। এরা নাকি ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস করে না, যুগের হাওয়ায় এরা টালমাটাল, এরা অখণ্ড বঙ্গ সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ইত্যাদি নানান্ কথা। এদের জন্য ইসলাম ও তমদ্দুন নাকি নিরাপদ নয়। কাজেই এরা ইসলামের দুষমন, রাষ্ট্রের শত্রু ইত্যাদি। স্বার্থসম্পন্ন মোল্লাশ্রেণীর সেই পুরাতন ‘ইসলাম বিপন্ন’ বাদের টেকনিকই যেন নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে।
...ফলত: পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য এখন গড়বার মুখে। এদেশের লোকদের মধ্যে জীবন জেগেছে, নতুন সাহিত্যও গড়ে উঠবে এদের মধ্য থেকে। তার আভাস চারদিকেই দেখতে পাচ্ছি—এখানকার অসংখ্য সাময়িকী সংবাদপত্র ও মাসিক পত্রগুলিতে। যে সব লেখক লিখছেন তারা সকলেই পূর্ব-পাকিস্তানের লোক এবং এখানকার জীবনের সঙ্গে তাঁদের পরিচয়ও ঘনিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, এক নবজাগ্রত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা লিখেছেন, যা আমাদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের সূচনা করছে। আমাদের সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই আসবে আমাদের সেই নবজাগরণের সুপ্রভাত বা রেনেসাঁস। সেই নতুন যুগের মশালধারী তরুণদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
তমদ্দুনপন্থীরা হয়তো বলবেন, তা কেন? আমরা বলেছি ভবিষ্যৎ সাহিত্য আমাদের, তোমাদের ওই কুফরী বাংলা সাহিত্য থেকে আলাদা হবে। ভালো কথা। কিন্তু তা হলে কি আমাদের পুরনো সাহিত্য বলে কিছু থাকবে না? অতীত থাকবে না আমাদের, অথচ গড়ে উঠবে ভবিষ্যৎ, একি কখনও সম্ভব? তা হলে ভবিষ্যৎ সাহিত্যের সৌধ গড়বো কিসের উপর?
তখন তমদ্দুনপন্থীরা বলেন, কেন বাংলা সাহিত্যে একটা আলাদা ইসলামী সাহিত্যই তো রয়েছে যার প্রকাশ দেখি পল্লী গীতিকাব্যগুলিতে এবং যার শ্রেষ্ঠ পরিচয় নজরুল ইসলাম ইত্যাদি। পাঠক লক্ষ্য করবেন, নিজের যুক্তির বিরুদ্ধে এঁরা আবার আমাদের বিভাগপূর্ব সাহিত্যের দিকেই নিয়ে যাচ্ছেন। তবে বলছেন হিন্দু সাহিত্য ছোঁব না। মুসলমানী সাহিত্য চাই। এ যেন “কায়েত হোটেলে খাব না বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ হোটেল চাই” ভাবখানা।
বেশ, মুসলমান যখন মুসলমানের রান্না খাওয়াই চাই। আসুন মুসলমানী সাহিত্যে। ...পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলে আপনারা যাঁকে বরণ করে নিয়েছেন, আমাদের সেই প্রিয় কবি নজরুল ইসলামকেই ধরুন। তাঁর সাহিত্যই কি তবে আপনাদের তামদ্দুনিক সাহিত্যের নমুনা? আনুন তাঁর সাহিত্য। খুলে দেখুন তাঁর বিখ্যাত গানের বই বনগীতি (যাতে বেশি সংখ্যক ইসলামী গান রয়েছে) ওর যে পৃষ্ঠায় আছে, “হে মদিনার বুলবুলি গো।” তার সামনা-সামনি পৃষ্ঠায়ই দেখুন “কালা, এত ভাল কি হে কদম্ব গাছের তলা?” যে পৃষ্ঠায় আছে “দীন দরিদ্র কাঙ্গালের তরে... হে হযরত” তার বিপরীত পৃষ্ঠায় দেখুন “আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়,” ঠিক তেমনি “পাঠাও বেহেশত হতে” এবং “জয় বাণী বিদ্যা-দায়িনী” আরও দেখুন এক পৃষ্ঠায় রয়েছে “মোহাম্মদ মোর নয়ন মনি” উল্টো পৃষ্ঠায় “আর লুকোবি কোথায় মা কালী” আবার “মোহাম্মদ নাম জপেছিলি” এবং “কে বাজিয়ে চলে বাঁশি, বিশ্বরাধা ওই সুরে উদাসী”। আর কত উদাহরণ দেব? এর কোন্টা ফেলে কোন্টা রাখবো। নজরুলেরই একটা হাসির গান মনে পড়ে গেল, “হেডমাষ্টারের টেড়ি, সেকেণ্ড মাষ্টারের দাড়ি কারে রাখি কারে ছাড়ি?”
সত্যিই এদের কুটিল প্রচারণার জোরে এরা একটি দূষিত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে এদেশে একটুখানি বন্ধুতা, মিলন বা মৈত্রীর কথা বলা পর্যন্ত অপরাধ ও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। বন্ধুকে পর্যন্ত খোলাখুলিভাবে ভালোবাসা জানানো যায় না। তাহলেই এরা ঐক্য প্রচেষ্টার জুজু দেখতে পায়। এইরকম বদ্ধ আবহাওয়ায় দম ফেটে মরবার অবস্থা। তাই আমরা একটু স্বস্তি চাই। একটু খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস ফেলতে চাই।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী রচনাবলী প্রথম খণ্ড থেকে