
টেলিভিশন, একসময় ছিল কেবল বিনোদনের মাধ্যম—সংবাদ, নাটক বা সিনেমা দেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। সেটি ছিল একেবারেই একমুখী, যেখানে দর্শক শুধু দেখতেন, কিন্তু কিছু নিয়ন্ত্রণ বা যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। সময়ের পরিক্রমায় টেলিভিশন হয়ে উঠেছে স্মার্ট, সংযুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটের বিশাল জগতে। এখন আমরা টেলিভিশনে ইউটিউব, নেটফ্লিক্সসহ বিভিন্ন ওটিটি চ্যানেলে কনটেন্ট দেখার পাশাপাশি গেমও খেলি। ভয়েস কমান্ডে টিভি চালু করা, বন্ধ করা—সবই সম্ভব মাত্র কয়েকটি ক্লিক বা কথার মাধ্যমে।
তবে এই স্মার্ট টিভির আরাম ও সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য বিপদ। কারণ, স্মার্ট টিভি এখন এক পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ডিভাইস, যেখানে থাকে ব্যক্তিগত তথ্য, অ্যাপ অ্যাকাউন্ট, এমনকি পেমেন্ট ডেটা। অর্থাৎ যেভাবে আপনার স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ হ্যাক হতে পারে, সেভাবেই আপনার টিভিও হতে পারে সাইবার অপরাধীদের নতুন টার্গেট। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাইবার সিকিউরিটি রিপোর্টে দেখা গেছে, স্মার্ট টিভির মাধ্যমে ম্যালওয়্যার, ডেটা লিক বা হ্যাকিংয়ের ঘটনা দ্রুত বাড়ছে।
স্মার্ট টিভি মূলত একটি কম্পিউটারভিত্তিক ডিভাইস। এতে রয়েছে অপারেটিং সিস্টেম, ওয়াই-ফাই সংযোগ, অ্যাপ ইনস্টলেশন সুবিধা, মাইক্রোফোন, ক্লাউড স্টোরেজ এবং ব্যবহারকারীর লগইন তথ্য। অর্থাৎ আপনি যখন নেটফ্লিক্স, ইউটিউব বা যেকোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সাইন-ইন করতে পারছেন, সে ক্ষেত্রে আপনার ই–মেইল, পাসওয়ার্ড, এমনকি পেমেন্ট ডেটাও টিভির মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে। এ তথ্যগুলোই হয়ে উঠছে সাইবার অপরাধীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। হ্যাকাররা ভুয়া আপডেট বা অনিরাপদ অ্যাপের মাধ্যমে টিভির সিস্টেমে প্রবেশ করে, পরে তা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ডেটা বা লগইন তথ্য চুরি করে নেয়।
ভুয়া অ্যাপ বা সফটওয়্যার আপডেট: অনেক সময় অজানা উৎস থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করলে হ্যাকাররা ম্যালওয়্যার ইনস্টল করে।
ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের দুর্বলতা: একই নেটওয়ার্কে সংযুক্ত ডিভাইস হ্যাক হলে টিভিতেও প্রবেশ করা সম্ভব হয়।
ওপেন পোর্ট ও ব্লুটুথ কানেকশন: নিরাপত্তাহীন পোর্ট বা অনিরাপদ ডিভাইস সংযুক্ত থাকলে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ভয়েস হ্যাক: অনেক সময় টিভির বিল্ট-ইন মাইক্রোফোন হ্যাক করে ব্যবহারকারীর কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়।
সাইবার হুমকি প্রতিহত করতে শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের টিভিতে উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থা যুক্ত করছে। এর মধ্যে অন্যতম পরিচিত হলো স্যামসাং নক্স সিকিউরিটি সিস্টেম, যা মূলত টিভির অ্যাপে মাল্টিলেয়ার প্রোটেকশন দেয়।
হার্ডওয়্যার-লেভেল সুরক্ষা: নক্স টিভির চিপ লেভেল থেকেই নিরাপত্তা দেয়, অর্থাৎ কেউ সফটওয়্যারে অনুপ্রবেশ করলেও মূল সিস্টেমে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
রিয়েল-টাইম থ্রেট মনিটরিং: এটি টিভিতে চলমান প্রতিটি অ্যাপ বা প্রক্রিয়া নজরদারি করে, সন্দেহজনক কার্যকলাপ শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে তা ব্লক করে দেয়।
ডেটা এনক্রিপশন: পেমেন্ট, লগইন ও অ্যাপ ডেটা এনক্রিপ্টেড অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে, ফলে চুরি হলেও তা পড়া যায় না।
নিয়মিত সিকিউরিটি আপডেট: নতুন ম্যালওয়্যার শনাক্ত হলে নক্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিকিউরিটি প্যাচ আপডেট পাঠায়।
স্মার্ট টিভির ভয়েস রিকগনিশন ফিচার ব্যবহারকারীর জন্য সুবিধাজনক হলেও সেগুলোই হতে পারে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় উৎস। টিভির সেটিংসে গিয়ে মাইক্রোফোনের ‘পারমিশন’ সীমিত করুন। টিভির ভয়েস কমান্ড ফিচার ব্যবহার করলে ‘অফলাইন ভয়েস কন্ট্রোল’ অপশন বেছে নিন, যাতে ভয়েস ডেটা ক্লাউডে না যায়।
স্মার্ট টিভির সিস্টেম আপডেট করার ক্ষেত্রে অনেকেই অবহেলা করেন। অথচ এখানেই লুকিয়ে থাকে বড় ঝুঁকি। প্রতিটি আপডেটের সঙ্গে নতুন সিকিউরিটি প্যাচ যুক্ত হয়, যা আগের ভার্সনের সমস্যাগুলো দূর করে। একইভাবে টিভির লগইন বা সাবস্ক্রিপশন অ্যাকাউন্টে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা এবং টু-স্টেপ ভেরিফিকেশন চালু রাখা অত্যন্ত জরুরি। এতে কেউ লগইন তথ্য পেলেও তা ব্যবহার করতে পারবে না।
• অচেনা ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে টিভি সংযুক্ত করবেন না।
• অজানা বা তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ ইনস্টল এড়িয়ে চলুন।
• পেমেন্ট বা সাবস্ক্রিপশন তথ্য গোপন রাখুন।
• নির্দিষ্ট সময় পর টিভির প্রাইভেসি সেটিংস রিভিউ করুন।
• রিমোটে ভয়েস কমান্ড ব্যবহার করলে কথাগুলো সার্ভারে সেভ হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করুন।
স্মার্ট টিভি আমাদের জীবনকে করেছে আরও সংযুক্ত ও আরামদায়ক। কিন্তু প্রযুক্তির এই আরাম যেন ঝুঁকিতে না পরিণত হয়, সে জন্য সচেতনতা সবচেয়ে বড় বিষয়। খেয়াল রাখতে হবে, টিভি আর কোনো একমুখী যন্ত্র নয়। এতে আপনার প্রদান করা তথ্যগুলো জমতে থাকে। তাই স্মার্ট টিভি কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে, এতে সিকিউরিটি সিস্টেম যেন শক্তিশালী হয়।