অনেকেই শুধু পরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু আর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ফেসবুক ব্যবহার করেন। তবে এখন সাধারণ যেকোনো ব্যবহারকারীও ফেসবুকে আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। এর জন্য কোনো পেজ খোলারও প্রয়োজন নেই। এই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের আগ্রহও আছে। তবে অনেকেই ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি নিয়ে শুরুতেই কিছু ভুল করে বসেন। আবার কনটেন্ট মনিটাইজেশন নিয়ে অনেকের কাছে সঠিক তথ্য থাকে না। ফেসবুক থেকে আয়ের খুঁটিনাটি তথ্যগুলো জেনে নেওয়া যাক।
আগে ফেসবুক থেকে আয় করার জন্য অনুসারী, ভিউসহ নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হতো, তবেই মনিটাইজেশন প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। তবে এখন নিয়ম বদলে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে ফেসবুকের কনটেন্ট নির্মাতা মুন্সী এনায়েত জানান, আগে শুধু পেজ থেকে ভিউ ও অনুসারীর নির্দিষ্ট সংখ্যা পূরণ করার পর ফেসবুক মনিটাইজেশনের মাধ্যমে আয় করা যেত। তবে এখন ফেসবুক পেজ ছাড়াও ব্যক্তিগত আইডি থেকে আয় করা সম্ভব। এ জন্য অবশ্যই ব্যক্তিগত আইডিকে প্রোফেশনাল মোডে রূপান্তর করতে হবে। ফেসবুক পেজ খোলার পর বা ব্যক্তিগত আইডিকে প্রোফেশনাল মোডে রূপান্তর করলেই যে আয় করার সুযোগ মিলবে বিষয়টি এমন নয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, মনিটাইজেশনের জন্য ফেসবুক থেকে ইনভাইটেশন পাওয়ার পরই কেবল আয় করার সুযোগ মেলে। সাধারণত ফেসবুক নোটিফিকেশন ও ই–মেইলের মাধ্যমে এই মনিটাইজেশন ইনভাইটেশন পাওয়া যায়। এরপর সেখানে নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করে মনিটাইজেশন চালু করা যায়। তবে ফেসবুক থেকে আয়ের বিষয়ে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে নতুন কিছু নিয়ম ও শর্ত যুক্ত হওয়ায় সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টকে প্রফেশনাল মোডে রূপান্তরের জন্য প্রথমে স্মার্টফোন থেকে ফেসবুক অ্যাপে প্রবেশ করে অ্যাকাউন্ট লগইন করতে হবে। এরপর প্রোফাইল পেজে যেতে হবে। প্রোফাইল পেজে ওপরের দিকে থাকা তিনটি ডট মেনুতে ট্যাপ করতে হবে। প্রদর্শিত অপশন থেকে টার্ন অন প্রফেশনাল মোড এ ট্যাপ করতে হবে। পরের পেজে টার্ন অন বাটনে প্রেস করতে হবে। পরের পেজে নিচে থাকা কনটিনিউ বাটনে প্রেস করলেই ব্যক্তিগত আইডি প্রোফেশনাল মোডে রূপান্তর হয়ে যাবে।
ফেসবুকের নতুন নিয়ম অনুযায়ী এখন সব ধরনের কনটেন্ট থেকেই আয় করার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মুন্সী এনায়েত জানান, ফেসবুক স্টোরিজ, সাধারণ টেক্সট পোস্ট, রিলস ভিডিও ও ছবিসহ সব কনটেন্ট থেকেই আয় করা যায়। এখন স্টার মনিটাইজেশন নিয়ে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীর আগ্রহ রয়েছে। অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও স্টার চেয়ে থাকেন। স্টার মূলত একটা গিফট প্রোগ্রাম, যেখানে কোনো নির্মাতাকে তাঁর অনুসরণকারীরা স্টারের মাধ্যমে গিফট দেওয়ার সুযোগ পান। রিলস ভিডিওতে এখনো ইন স্ট্রিম বিজ্ঞাপন দেখানোর মাধ্যমে আয়ের অংশ ভাগাভাগি করে নেয় ফেসবুক। আর ছবি, সাধারণ টেক্সট পোস্ট ও স্টোরিজের ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। সাধারণত ছবি, টেক্সট পোস্ট ও স্টোরিজের ক্ষেত্রে ফিডে প্রতি চারটি কনটেন্ট দেখার পর একটি বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এই প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনের আয় নির্মাতার সঙ্গে ভাগাভাগি করে ফেসবুক।
মনিটাইজেশন পাওয়ার পর পে–আউট অপশন থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যোগ করা যায়। যে অ্যাকাউন্ট যোগ করা হবে, সেই অ্যাকাউন্টেই উপার্জিত অর্থ জমা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দেশের যেকোনো ব্যাংক পে–আউট অপশন থেকে যোগ করা যাবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যোগ করার সুযোগ থাকলেও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এখনো যোগ করার সুযোগ নেই।
ফেসবুক থেকে উপার্জিত অর্থ তোলার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানতে হয়। রায়হানিজম ট্রাভেল অ্যান্ড ফুড পেজের স্বত্বাধিকারী ও কনটেন্ট নির্মাতা মীর রায়হান জানান, মনিটাইজেশন চালুর পর আপলোড করা প্রতিটি কনটেন্ট থেকে সামান্য করে অর্থ জমা হতে থাকে। কোনো কনটেন্ট থেকে হয়তো ১ ডলার আবার কোনো কনটেন্ট থেকে হয়তো ২০ থেকে ৩০ ডলারও জমা হয়। কিন্তু উপার্জিত টাকা তোলার জন্য অন্তত ১০০ ডলার জমা হতে হবে। ১০০ ডলার জমা হওয়ার পরই কেবল সে অর্থ তোলা যায়। পে–আউটে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট যোগ করার সুযোগ থাকলেও কিছু বাড়তি সতর্কতা মানতে হবে। অনেক ব্যাংকে ফেসবুক থেকে উপার্জিত অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আর তাই অ্যাকাউন্টের তথ্য যুক্ত করার আগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কোন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা তুললে ঝামেলা কম হবে, সে বিষয়ে পরিচিত কনটেন্ট নির্মাতাদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
ফেসবুকের মনিটাইজেশন পাওয়ার পর বিভিন্ন মেট্রিক্সের ওপর ভিত্তি করে একজন নির্মাতা টাকা পেয়ে থাকেন। সিপিএম বা কস্ট পার থাউজেন্ড ইমপ্রেশনস, সিপিসি বা কস্ট পার ক্লিক এবং সিটিআর বা ক্লিক থ্রু রেট এসব মেট্রিক্স মেনে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনের আয়ের অংশ ভাগাভাগি করে ফেসবুক।
মনিটাইজেশন পাওয়ার পর অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণত দুটি টুল ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে প্রোফেশনাল ড্যাশবোর্ড এবং ফেসবুক পেজের ক্ষেত্রে মেটা বিজনেস স্যুইটস ব্যবহার করা হয়। প্রোফেশনাল ড্যাশবোর্ডের তুলনায় মেটা বিজনেস স্যুইটসে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা থাকে। মেটা বিজনেস স্যুইটস ব্যবহার করে একটি পেজ চালানোর জন্য একাধিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া যায়। তবে প্রোফেশনাল মোডের ব্যক্তিগত আইডিতে একাধিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার সুযোগ নেই।
প্রতিদিন নিয়মিত বিরতিতে কনটেন্ট আপলোড করলে ফেসবুক থেকে ভালো আয় করার সুযোগ তৈরি হয়। এ বিষয়ে মীর রায়হান জানান, প্রতিদিন ফেসবুকে স্টোরিজ থেকে শুরু করে ভিডিও এমন ৫ থেকে ৭ ধরনের কনটেন্ট দেওয়া উচিত। এর ফলে দর্শকের সঙ্গে যুক্ততা বাড়বে। পাশাপাশি কোন সময়ে কনটেন্ট আপলোড করা হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত শুক্রবার সকালে এবং অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার পরের সময়কে কনটেন্ট আপলোডের জন্য পিক আওয়ার ধরা হয়। আবার রোজার সময় অনেকে সাহরির সময়েও ভালো ভিউ পেয়েছেন।
ফেসবুকে আপলোড করা সব কনটেন্ট থেকেই যেহেতু আয় করার সুযোগ রয়েছে, তাই প্রশ্ন উঠতে পারে কোন ধরনের কনটেন্ট থেকে বেশি আয় করা যায়। মীর রায়হান জানান, অন্যান্য কনটেন্টের তুলনায় স্টোরিজে আয় বেশি হয়। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট যদি বিবেচনা করা হয় তবে সব থেকে বেশি আয় করার সুযোগ রয়েছে স্টোরিজে। কারণ, একটি ছবি তোলা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ভিডিও তৈরির পেছনে সময় ও অর্থের বিনিয়োগের তারতম্য থাকে। ধরা যাক, একই সংখ্যক দর্শক দেখেছেন এমন স্টোরিজ থেকে ২ ডলার এসেছে আর ভিডিও থেকে আয় হয়েছে ৩ ডলার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরওআই বেশি স্টোরিজের। তবে স্টোরিজে আয় বেশি বলে অন্য কনটেন্ট কম আপলোড করলে তা পেজ বা অ্যাকাউন্টের গ্রোথে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই নিয়মিতভাবে ছবি, টেক্সট, স্টোরিজ ও রিলস ভিডিও দিয়ে দর্শকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
ফেসবুকের মনিটাইজেশনের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এগুলো অনুসরণ করে না চললে আয়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মুন্সী এনায়েত জানান, অন্যের ভিডিও চুরি করে আপলোড করলে, অশ্লীল কোনো আধেয় দিলে, হিংসা, ঘৃণা, বর্ণবাদ, নৃশংস কনটেন্ট আপলোড করলে আয়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মীর রায়হান জানান, মিউজিক এবং ল্যাংগুয়েজ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যের মিউজিক ব্যবহার করলে সেখানে কপিরাইটের জন্য অ্যাকাউন্টে স্ট্রাইক পাওয়ার শঙ্কা থাকে। এ জন্য ফেসবুকের নির্দিষ্ট মিউজিক লাইব্রেরি থেকে মিউজিক নামিয়ে সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার ইউটিউবের মিউজিক লাইব্রেরি থেকে নামানো মিউজিক ফেসবুক কনটেন্ট এ যুক্ত করলে কপিরাইট নিয়ে সমস্যা হতে পারে। ল্যাংগুয়েজ নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে। মজার ছলে আমরা অনেক ধরনের শব্দ কমেন্ট সেকশন বা পোস্টে ব্যবহার করি। কিন্তু ফেসবুকের অ্যালগরিদম সেগুলোকে হেট স্পিচ হিসেবে বিবেচনা করে পরবর্তী সময়ে স্ট্রাইক দিতে পারে।
মুন্সী এনায়েত জানান, যদি কনটেন্ট ক্রিয়েশনকে কেউ পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান তবে কখনোই আইডিকে প্রোফেশনাল মোডে রূপান্তর করা উচিত নয়। কারণ, আইডির রিচ একটি নির্দিষ্ট পরিসরে হয় কিন্তু পেজের রিচের কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। খুব অল্প কিছু আইডিতে ভালো রিচ আছে। চেষ্টা করতে হবে পেজ নিয়ে কাজ করতে। ফেসবুক থেকে আয় করার জন্য অবশ্যই একটি নিশ বেছে নিতে হবে এবং সেই নিশ স্পেসিফিক প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে। এভাবে অডিয়েন্সের কাছে একটি সলিড পরিচয় তৈরি হবে। ফেসবুকে সহজ করে কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে। অল্প কথায় কী বলতে চান, তা জানাতে হবে। হালকা মেজাজের কনটেন্ট, কৌতুক, হাস্যরসাত্মক কনটেন্টের ভিউ সাধারণত বেশি হয়।