প্রতিবছর অক্টোবর মাস এলেই সারা বিশ্বে নোবেল পুরস্কার নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয়। যাঁরা নোবেল জয় করেন তাঁদের নিয়ে তৈরি হয় নানা আলোচনা। তাই তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দুনিয়ার বাইরের সাধারণ মানুষেরাও বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন নতুন নোবেলজয়ীদের গল্প শুনতে। এ বছরের নোবেলজয়ীদের অজানা গল্প সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ ডেভোরেট ও জন এম মার্টিনিস। জন ক্লার্কের ছাত্র হলেন মিশেল এইচ ডেভোরেট ও জন এম মার্টিনিস। জন ক্লার্ক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর কাজে আরেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন বেশ প্রভাব রেখেছেন বলে জন ক্লার্ক মনে করেন। জন ক্লার্ককে আধুনিক এসকিউইউআইডি প্রযুক্তির বিকাশের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসকিউইউআইডি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সংবেদনশীল চৌম্বক সেন্সর। এই সেন্সর চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে ভূতত্ত্ব পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ক্লার্ক প্রথমে কেমব্রিজে গাণিতিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। পরে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে চলে যান। জন ক্লার্ক তাঁর কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময়, ৫০ বছরেরও বেশি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলেতে অতিবাহিত করেছেন। সেখানে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে বহু প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছেন। নোবেল পুরস্কারের আগে জন ক্লার্ক তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে ফ্রিটজ লন্ডন মেমোরিয়াল পুরস্কার।
ফ্রান্সের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মিশেল এইচ ডেভোরেট কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে একজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। ১৯৮০–এর দশকে বিজ্ঞানী জন ক্লার্ক তাঁর ডক্টরাল অ্যাডভাইজর ছিলেন। মিশেল বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ও তাঁর দলই প্রথম কার্যকরভাবে একটি ট্রান্সমন কিউবিটের কোয়ান্টাম বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেন। মিশেল তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে একাধিক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির সংখ্যা দুটি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার বাইরে মিশেল সংগীত ও শিল্পকলার প্রতিও গভীরভাবে আগ্রহী। ২০২৩ সালে তিনি গুগল কোয়ান্টাম এআইয়ে প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন।
জন এম মার্টিনিস কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে একজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। জন মার্টিনিস ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, সান্তা বারবারাতে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি গুগলের কোয়ান্টাম এআই দলের প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের আগে মার্টিনিস অতিসংবেদনশীল এক্স-রে ডিটেক্টর নিয়ে কাজ করতেন। তিনি এমন একটি মাইক্রো-ক্যালরিমিটার তৈরি করেন, যা খুব সামান্য শক্তিও সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পিয়ানো বাজাতে এবং বাদ্যযন্ত্র ঠিক করতে পছন্দ করেন বলে জানা গেছে। আশির দশকে বিজ্ঞানী জন ক্লার্ক তাঁর ডক্টরাল অ্যাডভাইজর ছিলেন। সে সময় তিনি মিশেল দ্যভোরের সঙ্গে কাজ করেছেন। ছাত্র ও শিক্ষক মিলে ১৯৮৫ সালে মাইক্রোওয়েভ পালস নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেন।
এ বছর রসায়নে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন ও ওমর এম ইয়াঘি। বিজ্ঞানী সুসুমু কিতাগাওয়া মূলত এমওএফ বা মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস নামের একধরনের ছিদ্রযুক্ত উপাদান আবিষ্কার ও উন্নয়নের জন্য বিখ্যাত। এ উপাদানগুলো দেখতে অনেকটা আণবিক স্পঞ্জ বা ফাঁপা জালের মতো, যা গ্যাস বা অন্যান্য অণু শুষে নিতে পারে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিয়োটো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন। বহু বছর ধরে তাঁকে রসায়নের নোবেল পুরস্কারের অন্যতম সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে মনে করা হয়েছে। বিজ্ঞানী কিতাগাওয়া তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। বৈজ্ঞানিক কাজের বাইরে কিতাগাওয়া অবসর সময়ে রান্না করতে পছন্দ করেন। নোবেল পাওয়ার পরের দিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের হাতে তৈরি রুটি পরিবেশন করেন।
ব্রিটিশ–অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী রিচার্ড রবসনকে এমওএফ নামের যুগান্তকারী রাসায়নিক যৌগ তৈরির ইতিহাসের একজন প্রধান পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও সুসুমু কিতাগাওয়ার মতো বিজ্ঞানীরা একে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেন। রবসন অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করার সময় এমওএফ নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রায় একই সময়ে জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়াও একই ধরনের কাজ করছিলেন। তিনি তাঁর কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন। তিনি নব্বইয়ের দশকে কো–অর্ডিনেশন পলিমার হিসেবে রসায়নের নতুন খাত তৈরির জন্য আলোচিত। তাঁর মেয়ে নওমি রবসন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করছেন।
ওমর এম ইয়াঘি প্রথম তাঁর উদ্ভাবিত ছিদ্রযুক্ত রাসায়নিক কাঠামোকে আনুষ্ঠানিকভাবে এমওএফ নাম দেন। এর আগে রিচার্ড রবসন বা সুসুমু কিতাগাওয়ার মতো বিজ্ঞানীরা এ ধরনের উপাদান তৈরি করলেও ইয়াঘির দেওয়া নামটিই বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইয়াঘি জর্ডানে জন্মগ্রহণ করেন ও বেড়ে ওঠেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় একটি তাঁবুতে, যেখানে তিনি ও তাঁর অন্য আট ভাইবোন পড়াশোনা করতেন। তিনি জর্ডান, সৌদি ও মার্কিন নাগরিক বলে জানা যায়। সৌদি রাজের ঘোষণায় তিনি ২০২১ সালে সৌদির নাগরিকত্ব পান। তাঁকে রেটিকুলার কেমিস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন ম্যারি ই ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল ও শিমন সাকাগুচি। মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যপ্রণালি বিষয়ে গবেষণার জন্য দুই মার্কিন ও এক জাপানি গবেষক এই পুরস্কার পেলেন। বিজ্ঞানী শিমোন সাকাগুচি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কোষ রেগুলেটরি টি সেলস আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। এই কোষগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং অটোইমিউন রোগ হওয়া থেকে বাঁচায়। তিনি জাপানের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওসাকা ইউনিভার্সিটিতে বহু বছর ধরে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। গবেষণার পাশাপাশি সাকাগুচি একজন চিকিৎসকও। তাঁর স্ত্রী নোরিকো একজন ডার্মাটোলজিস্ট। শৈশবে তাঁর বাবার লাইব্রেরি থেকে দর্শনের বই পড়ার কথা জানা যায়। ৪৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি স্থায়ীভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেননি। ৫০ বছর বয়সের পর থেকে তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হতে শুরু করে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে মুঠোফোন এড়িয়ে চলেন।
বিজ্ঞানী ফ্রেড রামসডেল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি নভো নরডিস্কে কাজ শুরু করেন। ২০১৯ সালে তিনি সোনোমা বায়োথেরাপিউটিকস চালু করেন। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিনে তিনিও তাঁর সাড়ে তিন সপ্তাহের ছুটিতে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে ঘোরাঘুরির সময় মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলেন। নোবেল কমিটি থেকে ফোন করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞানী মেরি ই ব্রাঙ্কো রেগুলেটরি টি সেলসের ক্ষেত্রে একজন অগ্রণী গবেষক। বিশেষ করে এ কোষগুলো কীভাবে কাজ করে ও শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় কী ভূমিকা পালন করে, তা বুঝতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। রিসার্চগেটের তথ্য অনুসারে, তাঁর প্রকাশনার সংখ্যা ৮৪। ভোর সাড়ে চারটার সময় নোবেল কমিটি তাঁকে ফোন করে পুরস্কারের কথা জানান; কিন্তু স্প্যাম কল ভেবে ফোন ধরেননি তিনি। পরে জানতে পারেন কলটি করেছিল নোবেল কমিটি।
সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ ও উইকিপিডিয়া