মেঘমুক্ত দিনে নীল রঙের আকাশ দেখে মুগ্ধ হন অনেকে। কেউ আবার আকাশ কেন নীল, তা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেন। আকাশ নীল রঙের দেখা গেলেও বিশাল মহাকাশ কিন্তু কালো দেখায়। মহাকাশ অভিযানের বিভিন্ন ছবি বা ভিডিওতে মহাকাশের রং কালো দেখে অবাকও হন অনেকে। আকাশের রং পুরোপুরি নির্ভর করে সূর্যের আলো কীভাবে পথ চলে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এলে কেমন আচরণ করে, তার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্যমতে, আলোর অণু বাতাসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুর সঙ্গে এমনভাবে মিথস্ক্রিয়া করে যা আমাদের চোখের দেখার ধরন বদলে দেয়। মাঝদুপুরের গাঢ় নীল থেকে গোধূলির অগ্নিঝরা লাল আকাশে সব রংই এই মিথস্ক্রিয়ার ফল।
সূর্যের আলো আমাদের চোখে সাদা মনে হলেও এটি আসলে সাতটি রঙের সমষ্টি। এই রং হলো লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, আসমানি ও বেগুনি। এটি দৃশ্যমান বর্ণালির অংশ। প্রিজমের মধ্য দিয়ে আলো গেলে বা বৃষ্টির পর আকাশে রংধনু উঠলে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আলোর প্রতিটি রং আসলে একেকটি তরঙ্গ। কিছু তরঙ্গ দীর্ঘ ও মসৃণ, আবার কিছু তরঙ্গ ছোট ও অমসৃণ। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি, যেখানে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক ছোট। আলো সাধারণত সোজা পথে চলে, যতক্ষণ না এটি কোনো বস্তুতে বাধা পায়।
সূর্যের আলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন এটি নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের মতো গ্যাসের অত্যন্ত ক্ষুদ্র অণুর মুখোমুখি হয়। এসব অণু আলোকে প্রতিফলিত করতে, বাঁকিয়ে দিতে বা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। আকাশ নীল হওয়ার প্রধান কারণ হলো, কণার বিক্ষিপ্তকরণ আচরণ। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হওয়ায় বাতাসের ক্ষুদ্র গ্যাস অণু একে খুব সহজে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। সূর্যের আলো যখন বায়ুমণ্ডলে ঢোকে, তখন নীল আলো সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়া নীল আলো আকাশের সব প্রান্ত থেকে আমাদের চোখে আসে বলেই আমরা আকাশকে নীল দেখি। অন্যদিকে লাল বা হলুদের মতো দীর্ঘ তরঙ্গের আলোগুলো খুব একটা না ছড়িয়ে সোজা পথে চলে যায়।
দিগন্তের দিকে তাকালে আকাশ প্রায়ই খুব হালকা নীল বা সাদাটে মনে হয়। এর কারণ হলো, ওই দিক থেকে আসা আলোকে বায়ুমণ্ডলের অনেক বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। এই দীর্ঘ পথে নীল আলো বারবার বিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে রংগুলো আবার মিশে যায়; ফলে আকাশ নীল ভাব হারিয়ে সাদাটে দেখায়। এ ছাড়া ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত আলোও দিগন্তের কাছের রঙের এই মিশ্রণে ভূমিকা রাখে। সূর্যাস্ত আলোর বিক্ষিপ্তকরণের একটি চমৎকার উদাহরণ।
দিগন্তের কাছে বা সূর্যাস্তের ঠিক পরে সূর্যকে গাঢ় লাল বা কমলা দেখা যায়। এর কারণ হলো, সূর্যাস্তের সময় সূর্যের আলোকে বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এই দীর্ঘ যাত্রায় নীল আলোগুলো পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, ফলে কেবল লাল আলোই পর্যবেক্ষকের চোখে পৌঁছায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় আলোর বিক্ষিপ্তকরণ। বাতাসে ধূলিকণা, দূষণ বা ধোঁয়া থাকলে এই প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়। ক্ষুদ্র কণাগুলো নীল আলোকে আরও বেশি ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে সূর্যকে আরও বেশি রক্তিম মনে হয়।
মহাকাশ কালো দেখা যাওয়ার কারণ হচ্ছে, মহাকাশে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। যেহেতু সেখানে কোনো বাতাস বা ধূলিকণা নেই, তাই সূর্যের আলোকে বিক্ষিপ্ত করার মতোও কিছু নেই। মহাকাশে সূর্যের আলো একটি সোজা রশ্মি হিসেবে ভ্রমণ করে। আপনি যদি সরাসরি সূর্যের দিকে তাকান, তবে উজ্জ্বল সাদা আলো দেখবেন। কিন্তু অন্য কোনো দিকে তাকালে আপনি অন্ধকার দেখবেন, কারণ সেখানে আলোকে বিক্ষিপ্ত করে আপনার চোখে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো মাধ্যম নেই। এ কারণেই দিনের বেলায়ও মহাকাশ কালো থাকে।
বায়ুমণ্ডলের ভিন্নতার কারণে অন্য গ্রহে আকাশের রং ভিন্ন হয়। মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা। এটি মূলত ৯৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সূক্ষ্ম ধূলিকণায় পূর্ণ। মঙ্গলে ধূলিকণা আলোকে এমনভাবে বিক্ষিপ্ত করে যা দিনের বেলা আকাশকে কমলা বা লালচে দেখায়। অবাক করা বিষয় হলো, মঙ্গলে সূর্যাস্তের সময় সূর্যের চারপাশের আকাশ নীলচে ধূসর দেখায়, যা পৃথিবীর ঠিক উল্টো!
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া