এস এম কামাল
এস এম কামাল

মৃত্যুবার্ষিকী

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম পথিকৃৎ এস এম কামাল

ক্যালেন্ডারের পাতায় আজকের দিনটি আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই। কিন্তু বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দিনটি বড্ড ভারী, গভীর বেদনার। গত বছর আজকের এই দিনে ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে মারা যান বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম পথিকৃৎ এস এম কামাল। আজ বৃহস্পতিবার তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

মৃত্যু ধ্রুব সত্য, কিন্তু কিছু মৃত্যু আমাদের বিবেকের দরজায় কড়া নেড়ে যায়, আমাদের অকৃতজ্ঞতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এস এম কামাল ছিলেন সেই মানুষ, যিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ বা ‘ডিজিটাল’ শব্দগুলো এ দেশের মানুষের কাছে ছিল ভিনগ্রহের গল্পের মতো। এস এম কামালকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনেকেই কর্মজীবনের ‘প্রধান শিক্ষক’ মনে করেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যে কয়জন মানুষের কাছে থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘তথ্যপ্রযুক্তির নায়কেরা’ সিরিজের প্রথম বইটি লেখার। সেই সুবাদে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।

এস এম কামালের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) প্রথম ব্যাচ থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইবিএমে পেশাজীবন শুরু করেন। চাইলে বিদেশের মাটিতে বিলাসী জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু মাটির টানে আর দেশের মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য নেশায় তিনি ফিরে এসেছিলেন।

আজ আমরা যে ‘তথ‍্যপ্রযুক্তির বাংলাদেশ’–এর সুফল ভোগ করছি, তার ভিত্তিপ্রস্তর যাঁদের হাতে স্থাপিত হয়েছিল, এস এম কামাল ছিলেন তাঁদের অগ্রনায়ক। আশির দশকে তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন বিসিএসের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। কেবল হার্ডওয়্যার নয়, সফটওয়্যার খাতের একমাত্র সংগঠন বেসিস প্রতিষ্ঠাকালেও তিনি ছিলেন কার্যনির্বাহী পরিষদের সক্রিয় সদস্য এবং পরবর্তী সময়ে সভাপতিও হন।

স্ত্রীর সঙ্গে এস এম কামাল। পেছনে বাঁ থেকে লেখক, বেসিসের সাবেক সভাপতি এ তৌহিদ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ এইচ কাফি

আমার মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা, যখন কম্পিউটারের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার, পাঠ্যবইয়ে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা কিংবা ভি-স্যাট ইন্টারনেট উন্মোচনসহ নানা বিষয়ে আমাদের সরকারি মহলের সঙ্গে নিয়মিত দেনদরবার করতে হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি আমলা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ হতো। আমার বয়স তখন কম, অনেক সময় আমি বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতাম, কিন্তু এস এম কামাল ঠান্ডা মাথায় নিজের লক্ষ্যে অটুট থেকে কাজ করতেন।

এস এম কামালের যে গুণ আমার সবচেয়ে ভালো লাগত, তা হচ্ছে হার না মেনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাওয়ার মানসিকতা। তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু বিসিএসের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ এইচ কাফির ভাষায় তিনি ছিলেন, সৎ, নির্মোহ ও প্রচারবিমুখ। তিনি ছিলেন সেই মাটির নিচের শিকড়, যা মহিরুহকে শক্ত করে ধরে রাখে, কিন্তু নিজে থাকে অন্ধকারে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মঞ্চের মধ্যমণি হওয়া কিংবা সস্তা হাততালির মোহ তাঁকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি।

এস এম কামালের জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা ‘তথ্যপ্রযুক্তির নায়কেরা’ সিরিজের প্রথম বই উপহার দিচ্ছেন লেখক

এস এম কামাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সফলভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এবং সরকার এস এম কামালকে তাঁর যোগ্য সম্মান দেয়নি। এটা আমাদের বিশাল ব্যর্থতা। আর তাই আমার মনে এখনো বিশাল দুঃখ ও লজ্জাবোধ কাজ করে।

এস এম কামাল, আপনি চলে গেছেন এক বছর হলো। কিন্তু আপনার হাতে গড়া দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিটি ধাপে আপনার অস্তিত্ব মিশে আছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে, আমাদের কাছে আপনিই সেই তথ‍্যপ্রযুক্তির নায়ক, যিনি নায়কদেরও নায়ক। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ‘মহানায়ক’।

আজকের এই দিনে আপনার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।