করোনায় কার লাভ, কার ক্ষতি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

সারা পৃথিবীতে তাণ্ডব চালাচ্ছে নতুন করোনাভাইরাস। বিশ্বের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের স্থানীয় রাজনীতিতেও নাক গলাচ্ছে কোভিড-১৯। মহামারি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে কোনো কোনো রাষ্ট্রনায়কের যেমন জনপ্রিয়তা আরও বাড়ছে, আবার কারও কারও জনসমর্থনের গ্রাফ নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে।

এমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়েই এখন নানা দেশ ব্যস্ত নতুন করোনাভাইরাস–সম্পর্কিত হিসাব নিয়ে। সংক্রমণের সংখ্যা, আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর হিসাব—মোটা দাগে এসব নিয়েই কাটছে দিনকাল। সেসব নিয়েই হচ্ছে নানা বিশ্লেষণ। করোনা মহামারির শুরুতেই যেসব দেশ মোটামুটি ভালোভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পেরেছে, সেসব দেশের রাষ্ট্রনায়কেরাও পাচ্ছেন বাড়তি জনসমর্থন। আর যাঁদের ঘেঁটে ঘা হয়ে গেছে, জনপ্রিয়তার রেসে তাঁরা পিছিয়ে পড়েছেন। কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্য আছে।

এই যেমন ধরা যাক দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির কথা। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন ও জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল—করোনাকালের আগে এই দুই রাষ্ট্রপ্রধানই ছিলেন জনপ্রিয়তার ভাটার টানে। বিশ্লেষকেরা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন যে তাঁরা নাকি রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ সময় পার করে ফেলেছেন। বাকি শুধু বিদায় নেওয়া!

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

কিন্তু করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শুরুতে দুজনেই একটু টলোমলো পায়ে এগোলেও, দ্রুতই দৌড়ানোর কৌশল রপ্ত করে ফেলেন মুন জে-ইন ও আঙ্গেলা ম্যার্কেল। দক্ষিণ কোরিয়া যেমন এশিয়ার মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে, ইউরোপে তেমনি অবস্থা জার্মানির।

নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, জার্মানিতে হয়েছে তার এক-চতুর্থাংশ। অথচ ইতালির চেয়ে জার্মানিতে জনসংখ্যা বেশি। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ৩০০-এর কম, যেখানে দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রে তা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ছবি: রয়টার্স

এমন পরিস্থিতির ইতিবাচক ফল দেখা গেছে এই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের জনপ্রিয়তায়। বার্লিনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাটেস্ট ডিমাপ জানাচ্ছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ম্যার্কেলের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন ছিল ৫৩ শতাংশ জার্মান নাগরিকের। আর চলতি মে মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৬৮ শতাংশে। গত মাসে প্রায় ৬৭ শতাংশ জার্মান নাগরিক বলেছেন যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ম্যার্কেলের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোর প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন আছে।

ওদিকে মুন জে-ইন তো একটা সাধারণ নির্বাচনেই জিতে গেলেন করোনা নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতায়। অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া এবং রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির দরুন গত বছরই গদি যায় যায় অবস্থা হয়েছিল তাঁর! ম্যার্কেলের অবস্থা ততটা খারাপ না হলেও, চ্যান্সেলর পদে পরিবর্তনের ডাক শোনা যাচ্ছিল জোরেশোরেই। কিন্তু এখন সব হুংকার থেমে গেছে নিমেষেই।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি

ওপরের দুজনের মতোই শুরুতেই লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গত মার্চের শেষ থেকে দেশজুড়েই নানা কঠোর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছিলেন তিনি। ফলও পাওয়া গেছে হাতেনাতে। আর তাতে জেসিন্ডার জনপ্রিয়তায় জোয়ার এসেছে বলে জানিয়েছে নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড নামের স্থানীয় গণমাধ্যম।

তাসমান উপকূলের আরেক দেশের প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনও কম যান না। সে দেশেও সংক্রমণের ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেজায় কম। অস্ট্রেলিয়ার কিছু রাজ্যে তো লকডাউন ভেঙে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরার সরকারি ডাকও দেওয়া হয়ে গেছে। মর্নিং কনসাল্ট নামের একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, স্কট মরিসনের জনপ্রিয়তা গড় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে গেছে। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে ভারত ও কানাডাতেও। নরেন্দ্র মোদি ও জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তাও আগের তুলনায় বেড়েছে। একই ধারায় আছেন ফ্রান্সের এমানুয়েল মাখোঁ।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। ছবি: রয়টার্স

তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনা পরিস্থিতি ততটা ভালো না হলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁর জনপ্রিয়তায় উল্লম্ফন উপভোগ করছেন। করোনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যায় এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য। তবে বিভিন্ন জরিপকারী সংস্থার হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখনো জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন বরিস জনসন। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের রাজনীতি বিষয়ের শিক্ষক টিম বেল মনে করেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং তাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাওয়া বরিসের জন্য শাপে বর হয়েছে। এর ফলে জনগণের অতিরিক্ত সহানুভূতি পাচ্ছেন বরিস। এবং এই কারণেই করোনা পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার ততটা দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলেও, বরিস জনসনের জনপ্রিয়তায় ধস নামেনি।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ছবি: রয়টার্স

ঠিক একই সময়ে করোনাভাইরাস বিষয়ে একের পর এক আলোচনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কখনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন, আবার কখনো নিজেই দিচ্ছেন দাওয়াইয়ের খোঁজ। শুধু তা-ই নয়, সংবাদ সম্মেলনে ঝগড়া করাও বাদ দেননি ট্রাম্প! আর এতসব উল্টোপাল্টা আচরণে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার পারদও নিচে নামা শুরু করেছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ও ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড গত মাসে এ নিয়ে এক জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া মোট আমেরিকানের ৫৪ শতাংশ ট্রাম্পকে ‘নেগেটিভ মার্ক’ দিয়েছেন।

বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স

অবশ্য গ্যালাপ পোলের হিসাব বলছে, নিজ দল রিপাবলিকানদের সমর্থন এখনো ট্রাম্পের প্রতিই আছে। আর সব মিলিয়ে এখনো গড় জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প।

রাশিয়ায় গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন লৌহমানব ভ্লাদিমির পুতিন। লেভাদা সেন্টার জানিয়েছে, গত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম রুশ জনগণের মধ্যে পুতিনের জনপ্রিয়তা সর্বনিম্ন সূচকে পৌঁছেছে। রাশিয়ার এই স্বাধীন জরিপকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, গত এপ্রিল মাসে ৫৯ শতাংশ রুশ নাগরিক পুতিনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। অথচ গত অক্টোবরেই এটা ছিল ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অর্থে চালিত প্রতিষ্ঠান ভিটিসিওমের আরেক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে পুতিনের ওপর তাদের আস্থা আছে।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে। ছবি: রয়টার্স

ব্লুমবার্গ বলছে, গত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন পুতিন। এরই মধ্যে দেশটির বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভের কথা শোনা গেছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাস পুতিনের জনপ্রিয়তায় যে ফাটল ধরিয়েছে, তা বলাই যায়।

ইতালির করোনা পরিস্থিতি সামলানোয় দক্ষতার পরিচয় দেওয়া প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে এখন স্বদেশি ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। ইতালির ইকসে ইনস্টিটিউটের করা ৫ মের জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৫৯ শতাংশ এখন আস্থা পাচ্ছেন কোঁতের কাজকর্মে। অথচ গত বছরই সরকারি জোটের ভাঙনের কারণে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন জিউসেপ কোঁতে। এমনকি তখন তাঁকে পদত্যাগও করতে হয়েছিল।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। ছবি: এএফপি

আর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের জনপ্রিয়তা ওঠানামা করছে। প্রথম দিকে যখন জাপানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল, তখন তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল। গত কিছুদিনে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় তা আবার কমে যায়। এখনো তাঁর প্রতি জাপানের নাগরিকদের সমর্থন কমতির দিকেই রয়েছে।

‘দ্য ইকোনমিস্ট’–এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মহামারি ও যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রপ্রধানদের জনপ্রিয়তায় কিছুটা উল্লম্ফন স্বাভাবিক। প্রায় সময়ই তা বেড়ে যায়। কিন্তু এটি খুবই স্বল্পস্থায়ী একটি বিষয়। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ ও মহামারি—এই দুই ক্ষেত্রেই বাস্তব পরিস্থিতি ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। ফলে এমন ঊর্ধ্বগামী জনপ্রিয়তা ও জনগণের ক্রমবর্ধমান আস্থায় ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে এবং ক্ষণিকের ব্যবধানেই তা ঘটতে পারে।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। ছবি: রয়টার্স

ভবিষ্যতে এসব বিশ্বনেতার জনপ্রিয়তার গ্রাফ কোন দিকে যাবে এবং তা পরবর্তী নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তার সবই তাই নতুন করোনাভাইরাস মহামারির ওপর নির্ভর করছে। এটুকু বলা যায় যে মহামারির দিনগুলোর কথা ভোটাররা সহজে মন থেকে মুছে ফেলবেন না।