৮০০ বছর পর আবার খুলছে নালন্দা

বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

উপমহাদেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা প্রায় ৮০০ বছর পর আবার খুলছে। উত্তর ভারতের বিহার রাজ্যের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বহিঃশত্রুর আক্রমণে ১১৯৩ সালে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নেতৃত্বে একদল রাজনীতিক ও পণ্ডিতের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবার চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটিকে আবারও আন্তর্জাতিক জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করতে উদ্যোক্তারা কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন বলে জানিয়েছে বিসিসি।
বার্তা সংস্থা বিবিসির এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বিশ্বের সেরা শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ধ্বংসাবশেষের পাশেই স্থাপিত হবে নতুন ভবন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার মানবিক, অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা, এশীয় একাঙ্গি ভবন, স্থিতিশীল উন্নয়ন এবং এশীয় ভাষাগুলোর ওপর পাঠদান শুরু হবে। ধীরে ধীরে এতে বৈচিত্র্য বাড়ানো হবে।

সংশয়

একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ ও মডেল অক্ষুণ্ন রেখে একটি অনুন্নত এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় নতুন করে গড়ে তোলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক ফিলিপ আল্টবাকের প্রশ্ন, ‘বিহারের গ্রামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞান আহরণে বিশ্বের সেরা ছাত্র বা শিক্ষকেরা আগ্রহী হবেন কি?’

এমন প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম আচার্য অমর্ত্য সেন অবশ্য এতটুকু টলেননি। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষাদান করা। এটা মাত্র শুরু। পুরোনো নালন্দা পুরোপুরি চালু হতে ২০০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। আমাদের হয়তো ২০০ বছর লাগবে না। কিন্তু কয়েক দশক তো লাগবেই।’

আচার্য আরও বলেন, ‘১১৯০সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও কয়েক বছর টিকে ছিল নালন্দা। এর কয়েক শ বছর পরও অনেকে দেখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষে পাঠদান চলছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পাঠদান সম্ভব হয়েছিল, পরে তা আর হয়নি। আর এখন সেখানে কিছুই নেই। আমাদের শুরু করতে হয়েছে ধ্বংস থেকে।’

পুরোনো নালন্দার আদলে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ২০০৬ সালে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড,  ভারত ও সিঙ্গাপুর একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়। পূর্ব এশীয় শীর্ষ বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বৈঠকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রও অংশ নিয়েছিল।

উদ্যোগ

পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রাজগির এলাকায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হচ্ছে। বৌদ্ধনীতি মেনে নতুন ভবনগুলো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

শুরুতে অস্থায়ী ভবনে পাঠদান শুরু হচ্ছে। স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গবেষণা প্রস্তাব চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ইতিহাস এবং বাস্তুবিদ্যা ও পরিবেশ—এ দুটি বিষয়ে পাঠদান শুরু হচ্ছে। অমর্ত্য সেন বলেন, নালন্দার শিক্ষাকার্যক্রমে শুরু থেকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অরণ্যবিদ্যা বিভাগ, ব্যাংককের চুলালনকরন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল বিশ্ববিদ্যালয় ও চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত থাকছে।

অধ্যাপক সেন বলেন, নতুন নালন্দা প্রেরণা ও প্রেষণার দিক দিয়ে এশীয় হবে। তবে জ্ঞানচর্চা, বিস্তার, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তির সংসর্গের দিক দিয়ে এশীয় হবে না। জ্ঞান যদি এশিয়ার জন্য প্রযোজ্য হয়, তবে তা অবশ্যই আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার জন্যও প্রযোজ্য হবে।

অমর্ত্য সেন বলেন, যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে, তবে ৮০০ বছর পর নালন্দার সুখ্যাতি আবার ছড়াবে।

আকাশছোঁয়াজ্ঞান

নালন্দা স্থাপিত হয়েছিল পঞ্চম শতকের কোনো একসময়। এটিতে একসময় ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই বৌদ্ধ ভিক্ষু। আর তাঁরা এসেছিলেন চীন, জাপান, কোরিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে।

চীনা ভিক্ষু জুয়ানজাং তাঁর স্মৃতিকথায় নালন্দার বিবরণ দিয়েছেন। সপ্তম শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন জুয়ানজাং। তাঁর ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পদদের কোনো ঘাটতি ছিল না। পাঠাগারটি ছিল নয়তলা উঁচু। দিন দিন সেটির উচ্চতা বাড়ছিল, যেন একসময় সেটি আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে।

সাংহাইয়ের লেখক মিশি সরন তাঁর ‘চেজিং দ্য মঙ্কস শ্যাডো’ বইয়ে জুয়ানজাং-এর ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। মিশি বলেন, ‘জুয়ানজাং চেয়েছিল এমন কারও কাছ থেকে শিক্ষা নিতে, যিনি বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো সম্পর্কে ভালো করে জানেন। সে সময় নালন্দা ক্ষমতা ও খ্যাতির শীর্ষে উঠে গেছে। কোরিয়া ও জাপানে সবাই নালন্দার নাম জানত।’

মিশি আরও বলেন, ‘জুয়ানজাং যখন নালন্দায় ছিল, তখন সেটি ছিল লোকে পূর্ণ। হাজারও পণ্ডিত প্রতিদিন সেমিনার করতেন, পাঠদান করতেন আর বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক করতেন। সেটি ছিল একরকম বৌদ্ধদের আইভি লিগ। বৌদ্ধমতের সব গভীর চেতনা নালন্দায় চর্চিত হতো ও এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ত।’

নালন্দার প্রভাব যে প্রবল ছিল, তা এখনো অনুমান করা যায়। গত জানুয়ারিতে রাজস্থানের জয়পুরের সাহিত্য সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিব্বতের দালাই লামা বলেন, ‘বৌদ্ধ জ্ঞানকাণ্ডে যা যা যুক্ত হয়েছে, তার সবই এসেছে নালন্দা হয়ে।’

সিঙ্গাপুরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নালন্দার আন্তর্জাতিক পরামর্শক সভার সদস্য জর্জ ইয়ো বলেন, ‘নালন্দা কেবল বৌদ্ধমতের চর্চা করত না। সেটিতে তখনই এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ চর্চা করা হতো। এটিতে পড়ানো হতো নাস্তিক্যবিদ্যা, জনস্বাস্থ্য, তর্কশাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, গণিত ও ভাষাবিজ্ঞান।’

আরওসংশয়

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক ফিলিপ আল্টবাক কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি বড় মাপের অনেক পণ্ডিত ও চিন্তককে আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের লোকেরা সাধারণত এমন একটি অবকাঠামো চান, যেখানে নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, আচরণ ও কফির দোকান আছে। একটি ক্যাম্পাসে যে ধরনের বুদ্ধিজীবীরা থাকেন, তাঁরা চান তারও বেশি কিছু।’

অবশ্য ভারতের বিহার এখন দেশটির সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান রাজ্য। এটির প্রবৃদ্ধি এখন ১২ শতাংশেরও বেশি।

জর্জ ইয়ো বলছেন, ‘এখনো গ্রামাঞ্চল বলে স্থানটিকে যথাযথ বলে মনে হচ্ছে না। এখন সেখানে কেবল লতাপাতার ঝাড়। কিন্তু দিন দিন দোকানের সংখ্যা বাড়ছে, শাড়িতে নতুন রং চড়ছে।’

বিহারের বিধায়ক ও নালন্দার পরিচালনা কমিটির সদস্য নন্দ কিশোর সিংহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলে এলাকার উন্নয়ন ঘটবে। এর চারদিকে প্রায় ৬০টি গ্রাম আছে। এগুলোতে কৃষি ও পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে উন্নয়নকাজ চলবে।

অমর্ত্য সেন বলেন, ‘এটিতে এরপর তথ্যপ্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি পড়ানো হবে। এর লক্ষ্য হলো কাজের সুযোগ তৈরি করা। এর মাধ্যমেই বিহার এত দ্রুত বিকশিত হবে যে, সে তখন বাকি ভারতের সঙ্গে পাল্লা দেবে।’

খরচ

নালন্দার জন্য ভূমি জোগাড় করে দিচ্ছে বিহার রাজ্য সরকার। এর জন্য ব্যয় হবে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যয় আকাশচুম্বী। এ অর্থে তার কিছুই হবে না। এ জন্য এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন দেশ।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বাস্তুবিদ্যা ও পরিবেশ বিভাগের একজন ডিনের খরচ দেবে অস্ট্রেলিয়া। নকশা, নির্মাণ ও পাঠাগারের জন্য সিঙ্গাপুর দেবে ৭০ লাখ ডলার। নির্মাণকাজে থাইল্যান্ড এক লাখ ও চীন ১০ লাখ ডলার দেবে।

অমর্ত্য সেন বলেন, ভারতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু এতে কাজ থেমে থাকবে না। প্রয়োজনে ধীরে ধীরে একটা একটা করে বিভাগ স্থাপন করা হবে।

ভারতেরঅর্জন

নালন্দার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশ ঘটবে নিঃসন্দেহে। এশিয়ার অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আন্তর্জাতিক মানের ও দৃষ্টিভঙ্গির হলেও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেবারেই অন্তর্মুখী ও স্থানিক।

লাওসে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সুখ দেও মুনি বলেন, ‘নালন্দার পুনর্জন্মে এটা প্রমাণিত হবে যে এশিয়ায় টিকে থাকার জন্য ভারত কেবল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতেই বড় নয়, জ্ঞানগত দিক দিয়েও শক্তিশালী।’

সিঙ্গাপুরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নালন্দার আন্তর্জাতিক পরামর্শক সভার সদস্য জর্জ ইয়ো বলেন, নালন্দা আবার চালু করার মধ্যদিয়ে এশিয়ার দুই প্রাচীন সভ্যতা চীন ও ভারত পরস্পরের কাছাকাছি আসবে। এতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কও প্রভাবিত হবে।