হলিউডের সাড়াজাগানো ‘টপ গান’ চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার আগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রজন্মের শিশুরা তাদের নানা রকমের জীবনের লক্ষ্যের কথা বলত। কেউ মহাকাশচারী হতে চাইত, আবার কেউ ক্রীড়াবিদ। তবে ‘টপ গান’ চলচ্চিত্র দেখার পর অনেকেই পরিকল্পনায় বদল আনতে শুরু করে। এটি দেখার পর কেউ কেউ বৈমানিকের পোশাক পরে আকাশে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জেট বিমান নিয়ে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করে।
বিশ্বে নানা ধরনের জেটের প্রচলন আছে। এর মধ্যে কিছু এদের গতি ও নকশার জন্য পেয়েছে অনন্যতা। সম্প্রতি বিশ্বের দ্রুতগতির শীর্ষ ১০টি জেট বিমানের একটি তালিকা করেছে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস। এই ১০ বিমান সম্পর্কে নানা তথ্য প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পরীক্ষামূলক জেট বিমান এক্স-৪৩ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১১ হাজার ৮৫৪ কিলোমিটার। এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৩টি এক্স-৪৩ উড়োজাহাজ তৈরি করেছে নাসা। এর মধ্যে ২০০১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর সময় একটি ধ্বংস হয়ে যায়। অপর দুটি সফলভাবে আকাশে উড়িয়ে ইচ্ছা করে সাগরে ধ্বংস করা হয়েছে। নাসা এক্স-৪৩–এর নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে ওড়ার জন্য এটিকে বোয়িং-৫২ থেকে ছাড়তে হয়। তবে এরপরও এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি উড়োজাহাজ।
লকহিড এসআর-৭১ জেট বিমান ব্ল্যাকবার্ড নামে পরিচিত। ১৯৯৯ সাল থেকে এ উড়োজাহাজটিকে আকাশে দেখা না গেলেও এটি বিশ্বে এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গতির জেট। এর গতি এতটাই যে যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্রকে এটি পেছনে ফেলতে সক্ষম। ১৯৬৬ সালে প্রথম এসআর-৭১–এর যাত্রা শুরু হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ জেটের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৪ হাজার ৪২ কিলোমিটার। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে শত্রুপক্ষের অবস্থানের তথ্য পেতে অনেক বেশি উঁচু দিয়ে ওড়ার জন্য এ উড়োজাহাজ তৈরি করা হয়। ১৯৭৬ সালে প্রায় ২৬ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে ওড়ার মধ্য দিয়ে রেকর্ড করেছিল এটি। এখন পর্যন্ত রেকর্ডটি ধরে রেখেছে এসআর-৭১। সর্বশেষ নাসা এসআর-৭১ পরিচালনা করেছে। উচ্চগতিতে অনেক উঁচু দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিতে তারা এ জেট ব্যবহার করে। গুঞ্জন আছে, ২০২৫ সালে লকহিড এসআর-৭১–এর উত্তরসূরি হিসেবে লকহিড এসআর-৭২ আসতে যাচ্ছে।
প্রায় ৬০ বছর আগে সর্বপ্রথম মিকোয়ান-গুরেভিচ মিগ-২৫ জেট আকাশে উড়েছিল। এটি এখনো বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ দ্রুতগতির জেট বিমান। মিগ-২৫ ফক্সব্যাটের সবচেয়ে নতুন সংস্করণটিকেও এখন প্রাচীনই বলা চলে। তবে এরপরও বিশ্বের কয়েকটি দেশে এখনো এ জেট ব্যবহার করতে দেখা যায়। জেট বিমানটি কমপক্ষে ঘণ্টায় ৩ হাজার ৯২০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। তবে অনেক উঁচু দিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ করার সময় ইঞ্জিনের ক্ষতি এড়াতে এর সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৩ হাজার ৪৬৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমিত রাখা হয়।
বিশ্বে সচল থাকা সবচেয়ে পুরোনো জেট বিমানগুলোর একটি মিগ-৩১। এটি মিগ-২৫–এরই একটি সংস্করণ। তবে মিগ-২৫–এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহারবান্ধব করে এটি তৈরি করা হয়েছে। মিগ-২৫ নিচু দিয়ে উড়তে পারে না। সে তুলনায় মিগ-৩১ উঁচু ও নিচু দুই উচ্চতা দিয়ে উড়তেই সমান পারদর্শী। মিগ-৩১ ফক্সহাউন্ড তালিকায় থাকা অন্যান্য জেট বিমানের মতো অতটা ক্ষিপ্র নয়। এটি রাডারে চিহ্নিত করা সহজ। তবে এর ভেতর বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসহ অন্যান্য অস্ত্র রাখার উপযোগী ‘অস্ত্রাগার’ আছে। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩ হাজার ৪৬৬ কিলোমিটার।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাকডনেল ডগলাসের তৈরি এফ-১৫ ইগল প্রায় ৫০ বছর ধরে টিকে আছে। এটি দ্রুতগতির যুদ্ধবিমানগুলোরও একটি। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩ হাজার ৮৭ কিলোমিটার। গতি একই রেখে এটি জটিল সব মোড় নিতে পারে। আর তাই কম দূরত্বের মধ্যে অন্য যুদ্ধবিমানের সঙ্গে লড়াইয়ে এটি একটি আদর্শ বিমান হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজ প্রদর্শনীর ক্ষেত্রেও এফ-১৫ ইগলের অনেক জনপ্রিয়তা আছে।
সুখোই সু-২৭ ফ্লেঙ্কার জেটের সর্বোচ্চ গতি ২ হাজার ৮৭৮ কিলোমিটার। বছরের পর বছর বিভিন্ন ধরনের অভিযানে অংশ নিয়েছে এটি। এ জেটের ওড়ার ক্ষমতা অসাধারণ। এক মিনিটেরও কম সময়ে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচুতে পৌঁছাতে পারে এটি। ৪০ বছর আগে যাত্রা শুরু করা সুখোই সু-২৭ জেটের এখনো বেশ গ্রহণযোগ্যতা আছে। বহুমুখিতা ও দারুণ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখনো এ ধরনের জেট বিমান উৎপাদন হচ্ছে।
মিগ-২৩ ফ্লগার জেট বিমানটি নানাভাবে পাখাকে ঘোরাতে পারে। এটি অত্যন্ত হালকা ও ক্ষিপ্র প্রকৃতির। কাছাকাছি দূরত্বে অন্য যুদ্ধবিমানের সঙ্গে লড়াই করার জন্য এ জেট বেশ উপযোগী। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২ হাজার ৮৭৮ কিলোমিটার। এর মানে গতির দিক থেকেও এ জেট বিমানকে টেক্কা দেওয়া কঠিন। ১৮ বছরে ৫ হাজারের বেশি এ ধরনের যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়েছে। মানসম্মত নির্মাণ বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো নকশা হওয়ার পরও এ উড়োজাহাজ কিছু দেশে এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এফ-১৪ টমক্যাট সম্ভবত ১৯৮৬ সালে মুক্তি পাওয়া মূল ‘টপ গান’ চলচ্চিত্রের ‘তারকা’ হিসেবে পরিচিত। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে ভালোভাবে জানাশোনা আছে, এমন মানুষেরা এটির তৎপরতা ও দুজনের বসার উপযোগী করে নির্মিত ককপিট সম্পর্কে জেনে থাকবেন। উড়োজাহাজ বহনের সক্ষমতাসম্পন্ন যান থেকে এটি পরিচালিত হয়ে থাকে।
এফ-১৪ বিমানে দুটো জেট ইঞ্জিন আছে। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২ হাজার ৮৮৯ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত জেট বিমানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে এফ-১৫ ইগলের মতো যুদ্ধবিমানগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে মিগ-২৯ ফালক্রাম নির্মাণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটি একটি হালকা ওজনের যুদ্ধবিমান। এটি এক ট্যাংক জ্বালানিতে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। আবার উড়ন্ত অবস্থাতেই এটিতে জ্বালানি ভরা যায়। এ জেট অত্যন্ত দ্রুতগতিরও। সর্বোচ্চ গতি ২ হাজার ৮১৭ কিলোমিটার। এই উড়োজাহাজ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে অনেক রুক্ষ রানওয়েতেও এটি অনায়াসে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে। এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মিগ-২৯ ব্যবহার করা হয়।
একক আসনের এফ-২২ র্যাপ্টর জেট নিজেই যেন এক ভয়ংকর অস্ত্র। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২ হাজার ৭৭৮ কিলোমিটার। এটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভর্তি থাকে। এই যুদ্ধবিমান রাডারে ধরা পড়ে না। রাডার থেকে এ জেটের অদৃশ্য থাকার সক্ষমতা এতটাই যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কারও কাছে এফ-২২ জেট বিক্রি করার অনুমতি নেই।
মাত্র ১৮৭টি এফ-২২ জেট তৈরির পর এর উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এ কারণে আকাশে এফ-২২ যুদ্ধবিমানের দেখা পাওয়াটা অনেকটাই বিরল বলা চলে।