ব্যর্থতা কাটাতে পারবে সোমালিয়া?

মোগাদিসুতে নাসাহাব্লাড হোটেলের বাইরে আত্মঘাতী হামলার পর বন্দুকযুদ্ধের সময় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সোমালি সরকারি বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। ছবিটি ২৫ জুন তোলা। ছবি: রয়টার্স
মোগাদিসুতে নাসাহাব্লাড হোটেলের বাইরে আত্মঘাতী হামলার পর বন্দুকযুদ্ধের সময় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সোমালি সরকারি বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। ছবিটি ২৫ জুন তোলা। ছবি: রয়টার্স

বিশৃঙ্খল দেশটিতে কার্যত কোনো সরকার নেই। লেগেই আছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যুদের উৎপাত। আর রাজধানী মোগাদিসুর রাস্তায় ইসলামপন্থী মিলিশিয়াদের দৌরাত্ম্য। এটি আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। এমন পরিস্থিতি কয়েক দশক ধরেই। এ থেকে উত্তরণে বাইরের দেশগুলো বছরের পর বছর তৎপরতা চালালেও কোনো হেরফের নেই। এখনো আফ্রিকার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র সোমালিয়া। 

দেশটির অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর। দেশটিকে পুনর্গঠনে জাতিসংঘের চেষ্টার অংশ হিসেবে এ বছর জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচন দেশটির ললাট থেকে ব্যর্থতার তকমা মুছতে পারে কি না, তাই এখন দেখার বিষয়।

সোমালিয়ায় কীভাবে নতুন সরকার গঠন করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতেই বিদেশি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আসছেন দেশটিতে। উঠছেন রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলে। বসছেন আলোচনায়। কিন্তু হোটেল কক্ষে যখন আলোচনা চলে, বাইরে চলে যুদ্ধ। কারণ, হোটেলগুলোই জঙ্গিদের মূল টার্গেট।

১৯৯১ সালে বিদ্রোহীরা সিয়াদ বেরে সরকারকে উৎখাত করে। এরপর থেকে দেশটিতে নামমাত্র সরকার বিরাজ করছে। নেই তেমন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। এমনই অবস্থা যে সরকারি কর্মকর্তারা চাইলে নিরাপদে দেশের যেকোনো জায়গায় যেতেও পারেন না। দেশটিতে ক্রমাগত যুদ্ধ, ক্ষুধা ও সন্ত্রাসের কারণে অনেকে পালিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। বলা হয়, এখন দেশটির ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখই দেশের বাইরে।

২০০৬ সালে প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়া সোমালিয়া থেকে কট্টর ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাতে হামলা চালায়। পরের বছর প্রতিবেশী দেশগুলোর সেনাবাহিনী দেশটিতে দখল নেয়। এই পরিস্থিতিতে দেশটিতে পশ্চিমা-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের জন্ম হয়, বিপরীতে জন্ম নেয় ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী আল-শাবাব।

গেরিলা যুদ্ধকারী এই জঙ্গিসংগঠনকে ঠেকাতে পশ্চিমা দেশগুলো আফ্রিকান ইউনিয়ন শান্তিরক্ষা মিশনে ২২ হাজার বিদেশি সেনা পাঠায়।

বর্তমানে শহরগুলোর পথে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমে এলেও এখনো সোমালিয়া নিরাপত্তার বেশ অভাব। অপহরণ বা এর চেয়ে খারাপ কিছু হওয়ার আতঙ্কে বিদেশিরা নিজেদের অনেকটা বিমানবন্দরেই বন্দী করে রাখেন। তাঁদের জন্য ট্যাক্সি বা সাঁজোয়া যানে করে বেড়াতে যাওয়াও মানে বিপদ ডেকে আনা। রাজধানীর যখন এই অবস্থা, তখন দেশটির অন্যান্য প্রান্তে কী ঘটতে পারে, তা অনুমেয়। বিশেষ করে দক্ষিণে। সেখানে শান্তিরক্ষী মিশনের ঘাঁটি থাকার পরও গ্রামগুলোতে আল-শাবাবের সদস্যরা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়, যা খুশি তা-ই করে।

চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি মোগাদিসুর লিদো সৈকতে সমুদ্রমুখী বিচ ভিউ ​ক্যাফের বাইরে গাড়ি বোমা হামলার ঘটে। ফাইল ছবি: রয়টার্স

তবে সোমালিয়ায় যে আগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তা মনে করেন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শেখ হাসান হামুদ। বলেন, কয়েক বছর আগে যেখানে প্রতিদিন অন্তত একজন হলেও পুলিশ সদস্য নিহত হতেন, সেখানে এখন ৫ থেকে ১০ মাসে এমন ঘটনা ঘটে। হামলার কবল থেকে ব্যবসায়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে এই পুলিশ কর্মকর্তার। বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সরকারি ভবনের নিরাপত্তায় তাঁর বাহিনীর লোকজনকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই ব্যর্থতা মেনে নিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের (ব্যবসায়ী) নিজস্ব নিরাপত্তা থাকা উচিত। পুলিশ কমিশনারের এমনটা বলার কারণ হলো বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামলার ঝুঁকি এড়াতে আল-শাবাবকে অর্থ দেওয়া শ্রেয় মনে করে। আর এর মধ্য দিয়ে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে সংগঠনটি।

দেশটিতে কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা থাকলেও রাজধানীর বাইরে নেই তেমন নিয়ন্ত্রণ। দেশটির ছোট রাজ্যগুলো কমবেশি স্বাধীনভাবেই নিজেদের শাসনভার পরিচালনা করেন। যেমন উত্তরে পুন্টল্যান্ড ভালোই সংগঠিত। তাদের রয়েছে নিজস্ব পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী।
যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ বছরে ২০ কোটি ডলার রাজস্ব আয় করে। আর এর বেশির ভাগ ব্যয় হয় পার্লামেন্ট মেম্বার ও প্রেসিডেন্সির পেছনে।

দেশটির নিজস্ব সেনাবাহিনী সোমালি ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ)। বাহিনীর কাজ হলো লোকজনকে নিরাপদে রাখা ও পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। তবে নামেই তারা রয়েছে। মূল কাজটি করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা। এসএনএ সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রিটিশ প্রশিক্ষক আনা হলেও মূলত তারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এএমআইএসওএম-কে। কেননা, এসএনএ কমান্ডাররা নিজেরাই জানেন না তাঁদের লোকজন কে কোথায় আছে। অনেক সময় সেনারা পালিয়ে যায় এবং মোগাদিসু নয়, বরং গোত্রীয় প্রধানদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কারণ, কেন্দ্রের বাইরে গোত্রীয় প্রধানদের রয়েছে বেশ প্রভাব।

এ অবস্থায় এবারের নির্বাচন আবশ্যক হয়ে উঠেছে। তবে সরকার টাকা দিয়েও নয়, সেনাবাহিনী দিয়ে নয়, কেবল আঞ্চলিক নেতাদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তাই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত দেশের বিভিন্ন জায়গার লোকজন ও প্রধান প্রধান গোত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ২০১২ সালে হাসান শেখ মোহাম্মদ পার্লামেন্ট সদস্যদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর এসব পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রায় ১৩৫টি গোত্রের প্রধানদের মাধ্যমে।

দুর্ভিক্ষের কারণে মার্কা লোয়ান সেবেলি অঞ্চল থেকে মোগাদিসুর দিকে সন্তানকে নিয়ে ছুটছেন এক মা। ছবিটি ২০১৪ সালের তোলা: রয়টার্স

আর নির্বাচনের তরি ভালোভাবে উতরে গেলেও যে তারা যে আইনগত বৈধতা পাবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কেননা, প্রধান সমস্যা হলো এখানে অভিবাসী সোমালিয়রা অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় ৫৫ শতাংশ সাংসদের রয়েছে বিদেশি পাসপোর্ট। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নিজে কখনো দেশের বাইরে না গেলে তাঁর বেশির ভাগ উপদেষ্টাই ব্রিটিশ বা মার্কিন সোমালীয়।

অন্যদিকে, গত ফেব্রুয়ারিতে এএমআইএসওএমের প্রধান দাতাগোষ্ঠী ইউরোপীয় ইউনিয়ন সোমালিয়ায় শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য বরাদ্দ ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। এরপর এই বাহিনীর ওপর হামলা বাড়ছে।

আগের দশকের তুলনায় যদিও সোমালিয়ার সমস্যাগুলোর অনেকটাই উন্নতি হয়েছে, তবু এ অবস্থায় বিদেশি সৈন্যদের পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া হলে দেশটি আবারও পুরোনো রূপে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে