নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন কর্নেল মাইকেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা। ১৭ অক্টোবর ২০২৫, আন্তানানারিভো
নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন কর্নেল মাইকেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা। ১৭ অক্টোবর ২০২৫, আন্তানানারিভো

মাদাগাস্কারে তরুণদের গণ-অভ্যুত্থানের সুবিধাভোগী কি তাহলে সেনাবাহিনী

‘এটি কোনো অভ্যুত্থান নয়।’ কথাটি মাদাগাস্কারের সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল মাইকেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনার। তিনি ১২ অক্টোবর মাদাগাস্কারে ‘অভ্যুত্থান’ ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছেন। সিএপিএসএটি নামে একটি বিশেষ সামরিক ইউনিটের কর্নেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা ১৪ অক্টোবর নিজেকে মাদাগাস্কের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেছেন, মালাগাসি জনগণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। মালাগাছি বলতে মাদাগাস্কারের নাগরিকদের বোঝানো হয়।

কর্নেল মাইকেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা গতকাল শুক্রবার মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন।

কয়েক সপ্তাহ ধরে মাদাগাস্কারের রাজধানী আন্তানানারিভোতে তরুণেরা প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। দেশটিতে বিদ্যুৎ ও পানির সংকটের কারণে প্রথমে সড়কে নেমেছিলেন তরুণেরা। ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া বিক্ষোভ সরকারের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে দমন করা হয়।

দেশটিতে বিক্ষোভ দ্রুত রূপ নেয় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, মৌলিক সেবার অভাবসহ বৃহত্তর অসন্তোষের এক গণ–অভ্যুত্থানে। এ বিক্ষোভকে নেপাল, মরক্কোসহ অন্যান্য দেশে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে গত শনিবার সমর্থন দেয় সিএপিএসএটি নামের সেনা ইউনিট। পরদিন এই ইউনিটের পক্ষ থেকে মাদাগাস্কারের পুরো সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পর থেকে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

রাজধানী আন্তানানারিভোর ১৩ মে স্কয়ারে হাজারো বিক্ষোভকারী নেচেগেয়ে স্লোগান দিতে দিতে রাজোয়েলিনার বিরুদ্ধে মিছিল করেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব ও সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সমর্থন পাওয়ায় মাদাগাস্কারকে ‘ফরাসি দালাল’ বলে আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভকারীরা নানা ব্যানারও প্রদর্শন করেন। অনেক বিক্ষোভকারীর হাতে ছিল মাদাগাস্কারের জাতীয় পতাকা ছিল।

বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সিএপিএসএটির কর্নেল মাইকেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা মঞ্চে উঠে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি সামরিক হস্তক্ষেপ মেনে নিতে প্রস্তুত?’ এরপরই জনতা উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়ে।

কর্নেল মাইকেল র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা

ফ্রান্সের সম্প্রচারমাধ্যম রেডিও আরএফআই সোমবার এক প্রতিবেদনে দাবি করে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেছেন রাজোয়েলিনা। ফরাসি সামরিক উড়োজাহাজে করে তাঁকে দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জেন-জি প্রজন্মের ব্যাপক বিক্ষোভ ও সেনাবাহিনীর একাংশের বিদ্রোহের মুখে দেশ ছাড়লেও পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন রাজোয়েলিনা।

পলাতক প্রেসিডেন্ট বলেছেন, নিজের জীবনের হুমকির কারণে তিনি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, জাতীয় পরিষদ তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায়। তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তাঁর সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হচ্ছে। রাজোয়েলিনা বর্তমানে দুবাইয়ে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মাদাগাস্কারের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে দুটি বৈশ্বিক প্রবণতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্রথমটি হলো বিশ্বজুড়ে আত্মপ্রকাশ করা জেন–জি প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের উত্থান। সাধারণত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশুদের জেন-জি বলা হয়। সে হিসাবে জেন-জি প্রজন্মের বয়স এখন ১৩ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে।

গত মাসে নেপালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করেন জেন–জিরা। এর আগে ইন্দোনেশিয়ার তরুণেরাও এ ধরনের বিক্ষোভ করেছেন। গত দুই বছরে কেনিয়া, পেরু ও বাংলাদেশেও তরুণেরা একইভাবে সড়কে নেমেছেন।

দ্বিতীয় প্রবণতাটি হলো আফ্রিকায় অভ্যুত্থানের ঢেউ। ২০২০-এর দশকে আফ্রিকায় দশম সফল সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে মাদাগাস্কারের এ অভ্যুত্থান। ২০০০ বা ২০১০-এর দশকের চেয়েও বেশি অভ্যুত্থান হয়েছে এ সময়ে। বিক্ষোভকারী তরুণেরা রাজোয়েলিনা সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা উল্টে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনী কি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়বে?

র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা দীর্ঘদিন ধরে রাজোয়েলিনা প্রশাসনের কড়া সমালোচক ছিলেন এবং ২০২৩ সালে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁকে কয়েক মাসের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত মাদাগাস্কারের জনগণ র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনাতেই বিশ্বাস রাখছে। তারা এ শতকে নিজেদের অন্যান্য রাজনৈতিক সংকটের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, শেষ পর্যন্ত দেশ আবার বেসামরিক শাসনে ফিরে আসবে।

২০০২ সালে কারচুপির নির্বাচনের পর সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষ নেয়, যা সংঘাত থামাতে সহায়তা করেছিল। ২০০৯ সালে বর্তমান পরিস্থিতির মতোই তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর সিএপিএসএটির নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে, যাতে ক্ষমতায় আসেন রাজোয়েলিনা। এর পর থেকে বেশির ভাগ সময়ই তিনি মাদাগাস্কার শাসন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্কিত নির্বাচনের অভিযোগ রয়েছে।

সাবেক ডিজে তারকা রাজোয়েলিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল অচিরেই জনগণের বিরাগভাজন হয়ে ওঠে। মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ১৯৬০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপি ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। দ্বীপটিতে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের কম আয়ে বেঁচে থাকে, যা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ হার। অন্যদিকে একটি ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণি অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে গেছে।

দেশটির দুর্নীতিবিরোধী কর্মী কেতাকান্দ্রিয়ানা রাফিতোসন বলেন, সরকারের শীর্ষ পদের লোকজন এত দিন দেশ ও এর প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দেখেছেন, মালাগাসি জনগণের সম্পদ হিসেবে নয়।

মাদাগাস্কারের পরিস্থিতি সবকিছুই এখন অনেকটাই নির্ভর করছে র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনার ওপর। ৫১ বছর বয়সী এই কর্মকর্তা মাদাগাস্কারেই তুলনামূলকভাবে অপরিচিত একটি নাম। ২০০৯ সালের অভ্যুত্থানে তাঁর বড় কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে ২০২৩ সালে কথিত এক বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে এক বছরের দণ্ড দেওয়া হয়। পরে ওই দণ্ড স্থগিত করা হয়েছিল।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা দেশের চরম দরিদ্র দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা এবং এমন একটি জনগোষ্ঠীর সদস্য, যাদের শিকড় মূলত আফ্রিকায়। অর্থাৎ তিনি প্রভাবশালী মেরিনা জাতিগোষ্ঠীর বাইরের একজন নেতা, যাদের বংশসূত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এই বহিরাগত পরিচয় তাঁকে দেশের নিপীড়িত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে (যদিও এটি ধনাঢ্য শ্রেণির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে পারে)।

ক্ষমতা গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছেন র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণে উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। জাতিসংঘ একে সংবিধানবিরোধী বলে নিন্দা জানিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন বুধবার মাদাগাস্কারের সদস্যপদ স্থগিত করেছে। সাংবাদিকদের র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা বলেছেন, অভ্যুত্থান তখনই হয়, যখন সেনারা অস্ত্র নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন, গুলি চালান, রক্তপাত হয়। এটি কোনো অভ্যুত্থান নয়।

এই সেনাশাসক বলেন, মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁর নিয়োগ অনুমোদন দেওয়ায় বোঝা যায় যে এ ক্ষমতা গ্রহণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হয়েছে। মাদাগাস্কার কোনো সামরিক শাসন বেছে নেয়নি। সরকার–বেসামরিক নাগরিক এবং প্রেসিডেন্ট কাউন্সিলও সামরিক ও বেসামরিক সদস্যদের নিয়ে গঠিত।

ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা বলেন, ‘ক্ষমতা জনগণের, আমার নয়।’ তিনি ক্ষমতা গ্রহণকে অভ্যুত্থান বলছেন না। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবেন।

স্থানীয় গণমাধ্যমকে র‍্যান্ড্রিয়ানিরিনা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য পরামর্শপ্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন কঠোর পরিশ্রম করব এবং খুব দ্রুত এগোব, যেন জনগণকে হতাশ না করি। আমরা অনেক কিছু পরিবর্তন করব এবং তাদের প্রত্যাশা পূরণ করব।’

তবে ইতিহাস বলছে, বিশ্বজুড়ে অভ্যুত্থানকারী নেতারা প্রায়ই এমন প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করেন না।

ইকোনমিস্ট, রয়টার্স ও এএফপি অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন