
উত্তর কোরিয়ার ধারাবাহিক সফল ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দেশটির দক্ষতা ও ক্রমবর্ধমান শক্তিকেই তুলে ধরছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। তাদের অগ্রগতি দ্রুত। দেশটি ৩ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বড় পরমাণু পরীক্ষা চালায়। এ ছাড়া ১৫ সেপ্টেম্বর জাপানের ওপর দিয়ে তারা দ্বিতীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে।
চলতি বছরে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা এটাই প্রমাণ করে যে তারা ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়নে সফল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডসহ দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মতো সক্ষমতা তাদের তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত মে মাসে উত্তর কোরিয়া হাসোং-১২ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। বিশ্লেষকদের ধারণা, ওই ক্ষেপণাস্ত্র সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামের মার্কিন ঘাঁটি এর সীমার মধ্যেই রয়েছে।
তবে দেশটি গত জুলাইয়ে হাসোং-১৪ ক্ষেপণাস্ত্রের দুটি পরীক্ষা চালায়, যার সক্ষমতা আরও বেশি এবং সম্ভবত ওই ক্ষেপণাস্ত্রই উত্তর কোরিয়ার প্রথম সত্যিকার আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম)। বিশ্লেষকদের ধারণা, এটি হাসোং-১২-এর দুই ধাপ অগ্রগামী সংস্করণ। এর সম্ভাব্য সীমা আট হাজার কিলোমিটার, যা নিউইয়র্কে আঘাত হানতে সক্ষম।
গত আগস্টে জাপানের ওপর দিয়ে হাসোং ১২ ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বিতীয় পরীক্ষা চালানো হয়। এটা ছিল জাপানের ওপর দিয়ে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম পরীক্ষা। একে ‘নজিরবিহীন হুমকি’ বলে বর্ণনা করা হয়। আর ১৫ সেপ্টেম্বর ওই ক্ষেপণাস্ত্রেরই দ্বিতীয় পরীক্ষা চালানো হয়, যা আগস্টে চালানো পরীক্ষার চেয়ে আরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে। এতে করে প্রতীয়মান হয়, উত্তর কোরিয়া পাল্লা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ওই ক্ষেপণাস্ত্রটির আরও উন্নতি ঘটিয়েছে।
এসব পরীক্ষার আপাত সাফল্য উত্তর কোরিয়া কীভাবে এত দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির উন্নয়ন ঘটিয়েছে, সেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) মাইকেল এলিম্যানের মতে, পিয়ংইয়ং সম্ভবত রাশিয়া ও ইউক্রেনের অবৈধ নেটওয়ার্ক থেকে উচ্চ কর্মক্ষমতার লিকুইড-প্রোপেল্যান্ট ইঞ্জিন সংগ্রহ করেছে।
এর আগে পিয়ংইয়ং দুটি আইসিবিএম প্রদর্শন করে, যা কেএন-০৮ ও কেএন-১৪ নামে পরিচিত। এখন পর্যন্ত তারা ওই ক্ষেপণাস্ত্র দুটির পরীক্ষা চালায়নি। ওই দুটি ক্ষেপণাস্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক কী, তাও পরিষ্কার নয়। মার্কিন সামরিক গোয়েন্দাদের এখনকার ধারণা, উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্রের ভেতরে স্থাপনে সক্ষম পরমাণু বিস্ফোরক মুখ তৈরিতেও সফল হয়েছে।
পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা
উত্তর কোরিয়া ২০০৬ সাল থেকে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করার পর এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি চালিয়েছে ৩ সেপ্টেম্বর। ওই পরীক্ষার সময় ৬ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। যেটি ছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চালানো পরীক্ষার চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী। ৩ সেপ্টেম্বর যে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়, তার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১০০ থেকে ৩৭০ কিলোটন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১০০ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় ফেলা পরমাণু বোমাটির চেয়ে ছয় গুণ বেশি শক্তিশালী।
উত্তর কোরিয়া দাবি করে, ৩ সেপ্টেম্বর যে অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়, সেটা ছিল হাইড্রোজেন (থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়েপন) বোমা। ওই দিন তারা এই অস্ত্রের প্রথম পরীক্ষা চালায়। পরমাণু বোমার চেয়ে হাইড্রোজেন বোমা কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী।
উত্তর কোরিয়া ১৯৮০-এর দশকে পরমাণু কর্মসূচি শুরু করে। ২০০৬ সালে তারা দশমিক ৭ কিলোটনের পরমাণু বোমার প্রথম পরীক্ষা চালায় বলে ধারণা করা হয়।
সামরিক বাহিনী
সামরিক খাতে উত্তর কোরিয়ার কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে, তা পরিষ্কার নয়। তবে দেশটির শাসননীতি হলো ব্যয়ের ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এই শাসননীতি ‘সংগুন’ নামে পরিচিত।
উত্তর কোরিয়ার রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম স্থায়ী বাহিনী। তবে বাহিনীর সরঞ্জাম সেকেলে। এরপরও যুদ্ধ বাধলে দেশটির প্রচলিত বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
১০ লাখের বেশি সদস্যের স্থায়ী বাহিনীর বাইরে দেশটির রিজার্ভ ফোর্স আছে ৫০ লাখ। বিশেষ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। যেকোনো ধরনের সংঘাতে এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢুকে পড়তে সক্ষম বলে ধারণা করা হয়।
আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি হলো, দেশটি সীমান্তজুড়ে গোলা ও রকেট লঞ্চার মোতায়েন রেখেছে। সেগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। যুদ্ধের ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন সম্প্রতি সামরিক ব্যয় বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন।
কোরীয় যুদ্ধের সময় থেকে কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিমাণ সেনা মোতায়েন রয়েছে তা বিশ্বের অন্য স্থানে মোতায়েন করা সেনাসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ধারণা, বিমানবাহিনীর নয় হাজার সদস্যসহ দেশটিতে বর্তমানে ২৮ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় ৩০০টি এম ১ আব্রামস ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাড স্থাপন করেছে। যুদ্ধ বাধলে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উত্তর কোরিয়ার স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ধারণা, বিশ্বের মধ্যে মার্কিন বাহিনীর সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি রয়েছে জাপানে। সেখানে মোতায়েন করা মার্কিন সেনাসংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার। এদের বেশির ভাগই বিমানবাহিনীর। মার্কিন সপ্তম বহরের সদর দপ্তর জাপানের ইয়োকোসুকায় অবস্থিত। সেখানে ইউএসএস রোনাল্ড রিগানসহ মোতায়েন রয়েছে ২০টি জাহাজ।
বিবিসি অবলম্বনে কৌশিক আহমেদ।