২০১৭ সালে রাখাইনে সেনা অভিযানের মুখে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়
২০১৭ সালে রাখাইনে সেনা অভিযানের মুখে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা টিকা পরিকল্পনা থেকে বাদ

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে করোনার টিকাদান শুরু করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। তবে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে জনবহুল আশ্রয়শিবিরগুলোতে ঠাঁই নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের এ উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেই তাদের। জান্তা নিযুক্ত স্থানীয় প্রশাসক এ তথ্য জানিয়েছেন। রয়টার্সের খবর।

২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন, জ্বালাও-পোড়াও, ধর্ষণ, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করা শুরু করে। বাড়িঘর হারিয়ে ও প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। আর নির্যাতন সয়ে রাখাইনের আশ্রয়শিবিরগুলোতে গিয়ে ওঠেন অনেকে। রাখাইনের এসব আশ্রয়শিবিরেও বৈষম্য ও দুর্ব্যবহারের শিকার হওয়ার অভিযোগ তাঁদের।

রাখাইনের সিত্তে ঘিঞ্জিময়, কর্দমাক্ত ও স্যাঁতসেঁতে আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এই বন্দিদশাতেও করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন শিবিরের বাসিন্দারা।

রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসক খিউ লিউইন রাখাইনের সিত্তে এলাকা থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, সিত্তে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষ যেমন: বয়স্ক ব্যক্তি, স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারি কর্মী ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে ১০ হাজার টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান এ কর্মসূচিতে আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী কোনো মুসলিমকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেই।

এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য আরও প্রকট করে তোলা হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে লিউইন কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তবে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুধু নির্দেশ পালন করছি।’ তিনি বলেন, কর্মসূচিতে কারা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন, তা নির্ভর করছে আমরা কত টিকা পাচ্ছি ও আমাদের কী নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, তার ওপরে। এখন পর্যন্ত আমরা রোহিঙ্গাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো ধরনের নির্দেশনা পাইনি।’

২০১৭ সালে রাখাইনে অভিযানে নেমেছিল সেনাবাহিনী। এরপর প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। রয়টার্স ফাইল ছবি

বিতর্কিত টিকাদান পরিকল্পনা বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মিয়ানমারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে বর্তমান জান্তা। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় সু চি ও তাঁর দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অনেককে। সু চির মুক্তির দাবিতে ও সামরিক শাসনের প্রতিবাদে দেশটিতে টানা বিক্ষোভ চলছে। প্রতিবাদে শরিক হয়েছেন অনেক স্বাস্থ্যকর্মীও। এতে দেশজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি এক রকম ভেঙে পড়েছে। তবে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সেনাবাহিনী এ কর্মসূচিকে গতিশীল করার চেষ্টা করছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মিয়ানমারে বর্তমানে গড়ে ৩০০ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের ধারণা, মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

আশ্রয়শিবিরেও সংক্রমণ করোনার
রাখাইনের সিত্তে ঘিঞ্জিময়, কর্দমাক্ত ও স্যাঁতসেঁতে আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এই বন্দিদশাতেও করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন শিবিরের বাসিন্দারা।

রোহিঙ্গারা টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে না—এটা দুঃখজনক, কিন্তু বিস্ময়ের নয়।
জ উইন, মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের বিশেষজ্ঞ

থেট কাল পাইন রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা নু মং। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী এই ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেন, সরবরাহ পর্যাপ্ত হলে যাতে টিকা দেওয়া যায়, সে জন্য কর্তৃপক্ষ শিবিরের ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের তালিকা নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিবিরের বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকা দেওয়ার কোনোরকম লক্ষণ নেই। নু মং বলেন, তাঁর নিজেরও করোনা উপসর্গ ছিল। কিন্তু পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, ‘শিবিরের অনেকে অসুস্থ। কয়েকজন মারাও গেছেন। তাঁদের বেশির ভাগ বয়স্ক ব্যক্তি।’

অবশ্য কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে না। মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের বিশেষজ্ঞ জ উইন বলেন, রোহিঙ্গারা টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে না—এটা দুঃখজনক, কিন্তু বিস্ময়ের নয়।