মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিহতদের স্বজনদের ভিড়
মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিহতদের স্বজনদের ভিড়

‘বিশ্বাসই করতে পারছি না, গোটা পরিবার নাই হয়ে গেল’

অত্যন্ত উৎসবের মেজাজে থাইল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার মায়েং জি সু-এর ভাতিজা ও ভাতিজার দুই ছেলে।

সন্তানদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আনন্দ উদ্‌যাপন করতে তাঁরা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনন্দ রূপ নিল বিষাদে।

গতকাল রোববার সকালে জেজু এয়ারের যে উড়োজাহাজটি দক্ষিণ কোরিয়ায় অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়, সেটির যাত্রী ছিলেন তাঁরা। এ ঘটনায় দুই ছেলেসহ এই বাবা নিহত হয়েছেন।

শুধু এই তিনজনই নন, উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় ফ্লাইটটির ১৮১ আরোহীর মধ্যে ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন।

৭৮ বছর বয়সী মায়েং বিবিসিকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে গোটা পরিবার নাই হয়ে গেল। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।’

উড়োজাহাজটির গন্তব্য ছিল ব্যাংকক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গতকাল দক্ষিণ কোরিয়ার স্থানীয় সময় সকাল ৯টার কিছু সময় পর উড়োজাহাজটি মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনাগুলোর একটি এটি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন ক্রু সদস্য আছেন। অপর দুজন ক্রু সদস্যকে উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সির তথ্য অনুসারে, ১৭৯ জন যাত্রীর বয়স ৩ থেকে ৭৮ বছরের মধ্যে। তবে বেশির ভাগেরই বয়স ৪০, ৫০ ও ৬০-এর কোটায়।

দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই থাই নাগরিক আছেন। অন্যরা সবাই দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী ৫ শিশু আছে। একজনের বয়স মাত্র তিন বছর।

ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সির খবরে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য উড়োজাহাজটিতে ছিলেন। তাঁরা হলেন তাঁর ভাবি, তাঁর মেয়ে, মেয়ের স্বামী ও মেয়ের শিশুসন্তান।

যাত্রীদের অনেকেই থাইল্যান্ডে বড়দিনের ছুটি উদ্‌যাপন করে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরছিলেন।

নিহত জংলুক ডুংমানির চাচাতো বোন পর্নফিছায়া চালের্মসিন বিবিসি থাইকে বলেন, খবরটি শোনার পর তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন।

পর্নফিছায়া চালের্মসিন বলেন, পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে থাইল্যান্ডে দুই সপ্তাহের বেশি সময় কাটান ডুংমানি।

জিওন জে-ইয়ং নামের ৭১ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তাঁর মেয়ে মি-সুক এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন। আঙুলের ছাপের মাধ্যমে তাঁর লাশ শনাক্ত করা হয়। বন্ধুদের সঙ্গে ব্যাংককে ভ্রমণ করছিলেন মি-সুক।

জিওন জে-ইয়ং বলেন, ‘আমার মেয়ে এভাবে শেষ হয়ে গেল! তাঁর বয়স ৪০-এর কোটার মাঝামাঝি।’

জিওন জে-ইয়ং আরও বলেন, ২১ ডিসেম্বর তিনি মেয়েকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন। তখন মেয়ে বাড়িতে কিছু খাবারদাবার ও আগামী বছরের বর্ষপঞ্জি নিয়ে এসেছিলেন। আর এটাই ছিল তাঁর সঙ্গে শেষবারের মতো কাটানো সময়।

মি-সুকের স্বামী ও কিশোর বয়সী এক মেয়ে আছে। মেয়ের মৃত্যু নিয়ে জিওন বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য।’

ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সিকে এক নারী বলেন, তাঁর বোন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে ছিলেন। তিনি তা কাটিয়ে উঠছিলেন। তিনি থাইল্যান্ড ভ্রমণে যান। শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হয়েছেন।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় যে দুই ক্রু সদস্য জীবিত উদ্ধার হয়েছেন, তাঁরা উড়োজাহাজের একেবারের শেষ দিকের অংশে ছিলেন। উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এই অংশ সবচেয়ে বেশি অক্ষত ছিল।

২ ক্রু সদস্যের একজন ৩৩ বছর বয়সী লি। ইয়োনহাপের খবরে বলা হয়, ঘটনার পর দ্রুত তাঁকে বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে আবার রাজধানী সিউলের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয় উড়োজাহাজটি। ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

হাসপাতালে চিকিৎসকদের লি বলেন, যখন তাঁর জ্ঞান ফেরে, তখন দেখতে পান, তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে।

এক সংবাদ সম্মেলনে হাসপাতালটির পরিচালক জু উং এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আহত এই ক্রু সদস্যের শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় ভেঙে গেছে। শরীর অচল (প্যারালাইসিস) হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকি তাঁর ক্ষেত্রে আছে। তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

ইয়োনহাপের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেঁচে যাওয়া আরেক ক্রুয়ের নাম কু। ২৫ বছর বয়সী এই নারীকে সিউলের একটি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মাথায় ও পায়ের গোড়ালিতে আঘাত লেগেছে, তবে তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানা গেছে।

ঠিক কী কারণে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হলো, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, বিধ্বস্ত হওয়ার আগে উড়োজাহাজটি সমস্যার মধ্যে পড়েছিল বলে তাঁর ধারণা।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রিয়জনদের মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটল, এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত কি না, এমন প্রশ্ন উঠছে।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় মেয়েকে হারানো জিওন রয়টার্সকে বলেন, বিমানবন্দরের কাছাকাছি যে পানি ছিল, তা গভীর নয়। সেখানে এই সিমেন্টের রানওয়ের চেয়ে নরম মাঠ আছে। পাইলট সেখানে অবতরণ করতে পারলেন না কেন?

জিওন বলেন, তাঁর মেয়ে মি-সুক তো প্রায় বাড়ির কাছাকাছিই এসে গিয়েছিলেন। তাই হয়তো তিনি ফোন করার মতো কোনো কারণ দেখতে পাননি।

জিওন আরও বলেন, ‘সে (মেয়ে) প্রায় বাড়ির কাছেই চলে এসেছিল। ভেবেছিল সে বাড়িতে আসছে।’