
মিয়ানমার সীমান্তের কাছে থাইল্যান্ডের ছোট্ট শহর মে সোতের উপকণ্ঠে একটি উলকি (ট্যাটু) আঁকার যন্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে, সঙ্গে বাজছে উচ্চ শব্দে পাঙ্ক মিউজিক।
শরীরে প্রচুর ট্যাটু আঁকা ইঙ্গ লা বলেন, ‘পাঙ্কের অর্থ স্বাধীনতা।’ থাইল্যান্ডের মে সোতে নিজের ‘পাঙ্ক বার’-এর পেছনে বসে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এক স্বদেশিকে ট্যাটু করে দেওয়ার সময় তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এটি কেবল গান বা ফ্যাশন নয়, এটি বেঁচে থাকার একটি উপায়।’
স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষাই ছিল মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন থেকে ইঙ্গ লা-এর পালিয়ে আসার অন্যতম কারণ। ২৮ বছর বয়সী এই তরুণ এখন থাইল্যান্ডে একজন নথিপত্রহীন নাগরিক হিসেবে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন।
তবে ইঙ্গ লা–এর মতে, জান্তা সরকারের হাতে বন্দী হওয়ার চেয়ে এটি অনেক ভালো। এই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধেই তিনি প্রথমে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং পরে অস্ত্র ধরেছিলেন।
ইঙ্গ লা বলেন, ‘সবচেয়ে বড় ভয় ছিল যদি আমি ধরা পড়ি, তবে আমাকে আবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা আর মৃত্যুকে ভয় পাই না। কিন্তু সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়া মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ।’
মে সোতে নির্বাসিত ইঙ্গ লা-এর এই গল্প মিয়ানমারের সেই সব হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর মতো, যাঁরা গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়েছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর তাঁর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল।
মিয়ানমারের ২০১৫ এবং ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দিয়েছে এই অভ্যুত্থান। অথচ এসব নির্বাচনকে দেশটির ইতিহাসে প্রথম সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সু চির দল বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিল।
সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে মিয়ানমারে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে বিমান হামলা, স্থলমাইন বিস্ফোরণ, বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুরো দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ইঙ্গ লা স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের শুরুতে জান্তা সরকার আদেশ দিয়েছিল, কেউ যেন ৭২ ঘণ্টা ঘরের বাইরে বের না হয় বা প্রতিবাদ না করে। সেই সময়ের মধ্যেই আমি আর আমার দুই বন্ধু হাতে তৈরি ব্যানার নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ করেছিলাম।’
গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে ইঙ্গ লা থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী জঙ্গলে পালিয়ে যান এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে (পিডিএফ) যোগ দেন। তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তিনি আবারও পালাতে বাধ্য হন। তিনি গোপনে থাইল্যান্ডে ঢুকে যান। সেখানেই সঙ্গিনীর সহযোগিতায় গড়ে তোলেন এই ট্যাটু পার্লার ও বার।
থাইল্যান্ডের জীবন নিয়ে ইঙ্গ লা বলেন, ‘অবৈধভাবে আসায় আমার কাছে কোনো কাগজপত্র ছিল না। কোথাও যেতে পারতাম না, টিকে থাকার জন্য কাজ জোগাড় করাও ছিল অসম্ভব।’
নথিপত্রহীন হওয়ার কারণে ইঙ্গ লা–কে প্রতিনিয়ত থাই কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন ফি বা ‘লাইসেন্স’ খরচ দিতে হয় এবং সব সময় দেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে থাকতে হয়।
‘আমাদের সব আশা-স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেছে’
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পক্ষে সেনাবাহিনীর যুক্তি ছিল, সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নির্বাচনে কারচুপি করে জিতেছে। এখন সেই সামরিক বাহিনী আগামী রোববার (২৮ ডিসেম্বর) নিজস্ব তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচনের আয়োজন করছে। তবে এই নির্বাচনকে বিশ্বজুড়ে একটি ‘প্রহসন’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়া।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ‘ডেমোক্রেটিক ভয়েস অব বার্মা’ (ডিভিবি) জানিয়েছে, নির্বাচনে অনেক দল নিবন্ধন করলেও অং সান সু চির জনপ্রিয় দল এনএলডিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস এই নির্বাচনকে ‘নকল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা বন্দী ও মৌলিক স্বাধীনতা নেই, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আল–জাজিরার প্রতিবেদক টনি চেং জানিয়েছেন, নির্বাচনের সমালোচনা করার দায়ে শিল্পী ও সংগীতজীবীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ইঙ্গ লা-এর মতো অনেকেই তাই দেশ ছাড়ছেন।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো জানিয়েছে, তারা এই নির্বাচনের ফল মেনে নেবে না। ইঙ্গ লা-এর কাছেও এই নির্বাচনের কোনো মূল্য নেই।