৩৩০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২৬৩টি এলাকায় নির্বাচন হবে। শুধু সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকায়গুলোতেই নির্বাচন হচ্ছে।
জয়ের সম্ভাবনা সেনাসমর্থিত ইউএসডিপির। ২০২০ সালের নির্বাচনে মাত্র ৬ শতাংশ আসন পেয়েছিল দলটি।
মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর তীরে মান্দালয় শহর। মানুষকে ভালো দিনের আশা দেখাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তাইজা কিয়াও। তিনি জান্তা সমর্থক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) থেকে নির্বাচনের একজন প্রার্থী। তাইজা কিয়াওয়ের ভাষণের সময়ই কমছিল উপস্থিত মানুষ। ভাষণ শেষে সেখানে আর কেউই ছিলেন না।
ওপরের চিত্রটা সাম্প্রতিক। আজ রোববার মিয়ানমারে শুরু হওয়া নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহের ঘাটতি এ ঘটনা থেকেই কিছুটা বোঝা যায়। কারণ, প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমার। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিভক্ত জাতি। এরপর সামরিক জান্তার মঞ্চস্থ এই নির্বাচনকে ভালো চোখে নিচ্ছেন না দেশ-বিদেশের মানুষ। নির্বাচনের পেছনে দেখা হচ্ছে অসৎ উদ্দেশ্য।
নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপ আজ। দ্বিতীয় ধাপ ১১ জানুয়ারি আর তৃতীয় ধাপ ২৫ জানুয়ারি। জানুয়ারির শেষে ফল ঘোষণা করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের মোট ৩৩০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২৬৩ এলাকায় নির্বাচন হবে। শুধু সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকায়গুলোতেই নির্বাচন হচ্ছে। অন্যান্য এলাকা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে।
মিয়ানমারের সাধারণত বহু মানুষের মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচন চায় না। ২০২১ সালে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জান্তা ক্ষমতায় এসেছিল। ওই দলটিও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। সরকারবিরোধী অনেক দলও নির্বাচনের মাঠে নেই। যে কটি দল নির্বাচন করছে, তার অনেকগুলোই সেনাসমর্থিত।
নির্বাচন নিয়ে মানুষের আপত্তির নানা কারণ রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকেও আপত্তি জানিয়ে বলা হচ্ছে যে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই এই নির্বাচনের আয়োজন করেছে জান্তা। এর মাধ্যমে বেসামরিক সরকার গঠন করা হলেও তা ঘুরবে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ছড়ির ইশারায়। বিদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কাছ থেকেও মিয়ানমার কিছুটা বেশি বৈধতা পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওপরে মান্দালয়ে সে সমাবেশের কথা বলা হয়েছে, সেখানে ইউএসডিপি কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল বিবিসি। তবে তাঁদের নাকি দলের নেতারা কথা বলতে মানা করেছেন। আসলে তাঁদের ভয়ের কারণটা আশপাশে থাকা উর্দিবিহীন সামরিক গোয়েন্দারা। ইউএসডিপি জান্তাসমর্থিত হলেও বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে গোয়েন্দা উপস্থিতিতে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা।
মিয়ানমারের এখন যদি কেউ নির্বাচনের সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে লাইকও দেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এরই মধ্যে কথা বলার সাহস দেখালেন এক নারী। তবে সবার চোখের আড়ালে, পরিচয় গোপন করে। তিনি বললেন, ‘এটা মিথ্যার নির্বাচন। সবাই তাঁদের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। অনেকে মারা গেছেন। অনেকে দেশ ছেড়েছেন। কীভাবে এসব ক্ষেত্রে বদল আসবে?’
এরপরও অসাধারণ এক নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী জান্তাপ্রধান হ্লাইং। তাঁর হাত ধরে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও বড়দিনে ইয়াঙ্গুনের এক গির্জায় উপস্থিত হয়ে মানুষে মানুষে বিদ্বেষের নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনেছে জাতিসংঘ। তাঁর শাসনামলে গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৯০ হাজার মানুষ।
নির্বাচন নিয়ে হ্লাইং যে চালাকিটা করছেন, তাতে চীনের কূটনৈতিক সমর্থন রয়েছে। নির্বাচনে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সমর্থনও দিচ্ছে বেইজিং। আর চীন ও রুশ অস্ত্র ব্যবহার করে জান্তাবিরোধী বিদ্রোহীদের দখল করা অঞ্চলগুলো মুক্ত করছে সামরিক বাহিনী। গত দুই বছরে এলাকাগুলো দখল করেছিল বিদ্রোহীরা। ভোটের শেষ নাগাদ তাদের কাছ থেকে আরও ভূখণ্ড উদ্ধারের আশা হ্লাইয়ের।
আর অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি মাঠে না থাকায় নির্বাচনে সেনাসমর্থিত ইউএসডিপি জয় পাবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০২০ সালে যখন মিয়ানমারের সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল, তখন দেশটির পার্লামেন্টে মাত্র ৬ শতাংশ আসন পেয়েছিল ইউএসডিপি। দলটি এবারের নির্বাচনে জয় পেলে মিন অং হ্লাইং প্রেসিডেন্ট পদেও বসতে পারেন বলে ধারণা কিছু পর্যবেক্ষকের।
মান্দালয় থেকে কিছুটা দূরে, ইরাবতী নদীর অপর পাশেই মিনগান গ্রাম। একসময় পর্যটকদের কাছে গ্রামটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল। তবে চার বছর ধরে মিনগানসহ মান্দালয়ের আশপাশের অনেক এলাকা জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের দখলে রয়েছে। সেখান থেকে প্রায়ই জান্তা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়।
মান্দালয় থেকে মিনগানে যেতে কয়েকটি তল্লাশিচৌকি পার হতে হয়। সেখানে বিবিসির সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তার। তিনি বলেন, ‘ওই এলাকা থেকে উত্তর দিকের বেশির ভাগ গ্রামে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। চলমান লড়াইয়ে সবাই কোনো না কোনো পক্ষ নিয়েছে। এটি খুবই জটিল একটি বিষয়। কেউই ছাড় দিতে রাজি নয়।’