আটক অভিবাসীদের বহনকারী দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ উড়োজাহাজটি ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আজ ১২ সেপ্টেম্বর, সিউল
আটক অভিবাসীদের বহনকারী দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ উড়োজাহাজটি ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আজ ১২ সেপ্টেম্বর, সিউল

যুক্তরাষ্ট্রে আটক কোরীয় শ্রমিকেরা দেশে ফিরলেন, এ ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে গত সপ্তাহে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হাতে আটক ৩০০ জনের বেশি দক্ষিণ কোরীয় কর্মী আজ শুক্রবার দেশে ফিরেছেন। ঘটনাটি দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষকে বিস্মিত করেছে। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও হুমকির মুখে পড়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়িশিল্পের এসব কর্মী জর্জিয়ার আটলান্টা থেকে রওনা দিয়ে আজ সিউলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে তাঁদের জন্য ছোট্ট ভিড় অপেক্ষা করছিল। ভিড়ের মধ্যে একজনের হাতে থাকা একটি ব্যানারে ছবি ছিল এমন—বন্দুক ও শিকল হাতে এক আইস এজেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখোশ পরে আছেন। আর এতে লেখা ছিল, ‘আমরা তো বন্ধু। তাই না?’

বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে কর্মীরা অপেক্ষারত তাঁদের প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হন। এ সময় তাঁদের কাঁদতে দেখা যায়। পার্ক নামের এক কর্মীর মা বলেন, তাঁর সন্তানকে আটক করার পর তিনি কোনোভাবেই আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

ওই নারী আজ শুক্রবার সিএনএনকে বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ যে আমার সন্তান সুস্থভাবে ফিরে এসেছে। আমার ছেলের অ্যালার্জির সমস্যা আছে। তাই এটা চিন্তার কারণ ছিল। তাকে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরানো অবস্থায় কল্পনা করাটাই এক ভয়ংকর মানসিক আঘাতের মতো।’

আরেক কর্মীর মা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট—আইসের অভিযানের ভিডিওগুলো দেখে ‘তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন’। তিনি আশা করেন, একদিন তাঁর ছেলে নিরাপদে বিদেশে কাজ করতে যেতে পারবেন। তবে আপাতত তিনি আর তাঁর সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে চান না।

যুক্তরাষ্ট্রে আটক কোরীয় কর্মীদের গত সপ্তাহ সম্ভবত বেশ বিভ্রান্তি ও ভয়ের মধ্যে কেটেছে। অভিযানের সময় তাঁদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। বেশ কয়েক দিন তাঁদের আটকে রাখা হয়েছিল।

কোরীয় কর্মীরা যখন আইসের বন্দিশালায় ছিলেন, তখন বাইরে চলছিল আসল উত্তেজনা। দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিক তাঁদের মুক্তির জন্য আলোচনা করতে ওয়াশিংটনে ছুটে যান। আর দেশে এ ঘটনাকে বহুদিনের বন্ধুর কাছ থেকে ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে দেখে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

১৯৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় দুই দেশ সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি সামরিক ঘাঁটি দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে মার্কিন সেনা ও তাঁদের পরিবারসহ ৪১ হাজার মার্কিন নাগরিক থাকেন।

তাই আইস এজেন্টরা যখন দক্ষ কর্মীদের হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়েছে আর সেই ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তা দেখে দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যে অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের কারণে এই কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, সেই অংশীদারত্ব নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। অথচ এমন অংশীদারত্বকে ট্রাম্প নিজেই উৎসাহিত করেছেন।

গত আগস্টে ট্রাম্পের সঙ্গে এক বৈঠকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং তাঁর দেশের কোরিয়ার বড় বড় কোম্পানির যুক্তরাষ্ট্রে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

গাড়ি নির্মাণপ্রতিষ্ঠান হুন্দাই সেই বিনিয়োগ প্রচেষ্টার অংশ ছিল। হুন্দাইয়ের চেয়ারম্যান গত মার্চে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার পর যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আগস্টে লি-ট্রাম্প বৈঠকের পর আরও ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ বাড়িয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে কোরীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন। তাই জর্জিয়ায় হুন্দাই ও এলজির যৌথ মালিকানাধীন ব্যাটারি প্ল্যান্টে আইসের অভিযান অনেককে হতবাক করে।

কোরীয় কর্মীদের ভিসার ‘শ্রেণি’ কী ছিল, তা স্পষ্ট নয়। অভিবাসন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, অনেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছিলেন। তবে আটক কর্মীদের আইনজীবীরা জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁদের মক্কেলরা জর্জিয়ার প্ল্যান্টে বৈধভাবে কাজ করছিলেন।

এ ঘটনার পর এটাও স্পষ্ট নয় যে জর্জিয়ার এই কারখানায় এই কর্মীদের আবার কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে কি না, যুক্তরাষ্ট্রে কোরীয় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ বা হুন্দাই গাড়ি কারখানার কী হবে।

মার্কিন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে অস্পষ্ট একটি উত্তর দিয়েছেন। তাঁদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাঁরা দ্রুত কোরীয় কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

বিমানবন্দরে স্বজনদের সঙ্গে দেশে ফেরত কোরিয়ার এক শ্রমিক। এ সময় স্বজনদের কাঁদতে দেখা যায়। আজ ১২ সেপ্টেম্বর, ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি গতকাল বৃহস্পতিবার আরও কঠোর সুরে কথা বলেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে কোরীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ‘খুবই বিভ্রান্তিকর’। এমন পরিস্থিতিতে তারা প্রশ্ন তুলবে, ‘তাদের আদৌ সেখানে (যুক্তরাষ্ট্র) যাওয়া উচিত কিনা।’ তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা ‘যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি বিনিয়োগের ওপর বড় ধরনের প্রভাব’ ফেলতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট আরও যোগ করেন, কোরীয় কর্মীদের জন্য নতুন ভিসা বিভাগ তৈরি বা ভিসার কোটা বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে।

বৃহস্পতিবার হুন্দাইয়ের সিইও হোসে মুনোজ জানিয়েছেন, জর্জিয়ায় ব্যাটারি প্ল্যান্টটি চালু হতে দুই থেকে তিন মাস দেরি হতে পারে।

জর্জিয়ার এটিই হবে যুক্তরাষ্ট্রে হুন্দাইয়ের প্রথম সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং ব্যাটারি তৈরির কারখানা। রাজ্যের নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮ হাজার ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে।

কারখানায় আইসের অভিযানের পর সেই প্রতিশ্রুতি এখন অনিশ্চিত মনে হচ্ছে। স্থায়ী কর্মীদের খুব কমই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমপ্লেক্সটি এখনো নির্মাণাধীন এবং বেশির ভাগ কর্মী অস্থায়ী ভিসা বা চুক্তিতে কাজ করা শ্রমিক।

মুনোজ রয়টার্সকে বলেছেন, আটক কর্মীদের বেশির ভাগই এলজির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করত। হুন্দাই আপাতত অন্য প্ল্যান্ট থেকে ব্যাটারি সংগ্রহ করবে।

তবে কারখানায় ধীরে ধীরে কাজ শুরু হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মনে বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন করে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তার রেশ হয়তো অনেক দিন থাকবে।