এসজি-১ ফ্যাথম
এসজি-১ ফ্যাথম

রাশিয়ার সাবমেরিন রুখতে আটলান্টিকের গভীরে যুক্তরাজ্যের ড্রোন, কতটা কাজে দেবে

আটলান্টিক মহাসাগরে স্কটল্যান্ডের পশ্চিত উপকূল। সাগরের পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো সাবমেরিন আকৃতির ছোট একটি যন্ত্র। দেখতে ডানাওয়ালা টর্পেডো বা পানির নিচ দিয়ে চলা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো। দ্রুতই সেটি হারিয়ে গেল গভীর সমুদ্রে।

এই যন্ত্র আসলে একধরনের ড্রোন। নাম ‘এসজি–১ ফ্যাথম’। ফ্যাথমের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ক্যাটি রেইন বলেন, এই ড্রোনগুলো গভীর সাগরে টহল দিতে পারে। একই সঙ্গে সাগরের ওই অঞ্চলে শত্রুপক্ষের যেকোনো ধরনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে।

শত্রু বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর সাবমেরিনগুলোকে। অনেক সময় সেগুলো যুক্তরাজ্যের জলসীমার কাছাকাছি এসে গোপনে অভিযান চালায়। সন্দেহ করা হয়, সাগরের নিচে যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তার ও পাইপলাইনের তথ্য নিতে গোয়েন্দা জাহাজের সঙ্গে মিলে কাজ করে এসব রুশ সাবমেরিন।

রাশিয়ার মহাসাগর গবেষণাসংক্রান্ত নৌযান ইয়ানতার গত মাসে যুক্তরাজ্যের জলসীমার নিচের তার ও পাইপলাইনের তথ্য নিচ্ছিল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ওই নৌযান থেকে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমানের পাইলটদের ওপর লেজার রশ্মি ফেলা হয়েছিল।

ফ্যাথম তৈরি করেছে জার্মানির প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান হেলসিং। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভি এটির আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছে। ফ্যাথম সাগরের নিচ দিয়ে নিঃশব্দে চলাচল করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের সেন্সরের মাধ্যমে অবিরাম সংগ্রহ করে যেতে পারে নানা তথ্য।

সাগরের নিচে মাসের পর মাস ধরে টহল দিয়ে যেতে পারে এ ড্রোন। এ ক্ষেত্রে একই ধরনের অন্যান্য ড্রোনের সহায়তা নিতে পারে তারা। এগুলো পরিচালনার সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে দশকের পর দশক ধরে গড়ে তোলা তথ্যভান্ডারের ওপর ভিত্তি করে। ক্যাটি রেইন বলেন, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এগুলো বেশি দ্রুত হুমকি শনাক্ত করতে পারে।

ফ্যাথম যদি শেষ পর্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে তা আটলান্টিক ব্যাস্টিয়নের একটি অংশ হতে পারে। রয়্যাল নেভির আটলান্টিক ব্যাস্টিয়ন ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ ও নজরদারি উড়োজাহাজের একটি নেটওয়ার্ক। আটলান্টিক মহাসাগরে যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামোর সুরক্ষা দেওয়াই এ নেটওয়ার্কের কাজ।

আটলান্টিক ব্যাস্টিয়ন নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রাশিয়ার সাবমেরিনের এবং পানির নিচে দেশটির অন্যান্য কার্যক্রমে নতুন করে যে তৎপরতা শুরু হয়েছে, তার সরাসরি জবাব এই নেটওয়ার্ক। যুক্তরাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে তাদের জলসীমার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা রুশ নৌযানের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে।

রাশিয়ার একটি সাবমেরিন

রাশিয়ার মহাসাগর গবেষণাসংক্রান্ত নৌযান ইয়ানতার গত মাসে যুক্তরাজ্যের জলসীমার নিচের তার ও পাইপলাইনের তথ্য নিচ্ছিল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ওই নৌযান থেকে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমানের পাইলটদের ওপর লেজার রশ্মি ফেলা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের জলসীমার কাছে রুশ নৌযানটির ওপর নজরদারি করছিল ওই যুদ্ধবিমানগুলো।

রাশিয়ার নৌযানের ওই কর্মকাণ্ডকে ‘খুবই বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলে। গত সপ্তাহে দেশটির পোর্টসমাউথ শহর সফরের সময় তিনি বলেছিলেন, এ ধরনের হুমকি মোকাবিলার জন্য নতুন প্রযুক্তিতে সরকারের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

র‍য়্যাল নেভির জাহাজ ‘পঞ্চদশ প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট’–এ বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা পল অ্যাডামসের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয়েছিল জন হিলের। এই জাহাজ নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জন হিলে বলেন, রাশিয়ার চেয়ে যুক্তরাজ্যকে এগিয়ে রাখার জন্যই হুমকি মোকাবিলায় নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের প্রয়োজন।

তখন এসব নতুন প্রযুক্তির কিছু প্রদর্শন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দূরনিয়ন্ত্রিত স্পিডবোট। ছিল যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনীর প্রথম পাইলটবিহীন হেলিকপ্টারের একটি নমুনা। আরও ছিল ১২ মিটার দীর্ঘ ও ১৯ টন ওজনের একটি সাবমেরিন। সাবমেরিনটি চালানোর জন্য সেটিতে মানুষ থাকা লাগে না। চলতি বছরের প্রথম দিকে সেটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়েছিল।

রুশ হুমকি মোকাবিলায় রয়্যাল নেভির নতুন কৌশল কাগজ-কলমে ভালো মনে হলেও তা মুখোশ দিয়ে সমস্যা আড়াল করার মতো বলে উল্লেখ করেছেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান র‍য়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার রবার্টস।

সে সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলে বলেছিলেন, ‘আমরা জানি, রাশিয়া কী ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। তাদের জাহাজ ও সাবমেরিনগুলো কী করছে, তা আমরা শনাক্ত করছি। আমরা জানি, তারা আমাদের সাগরের নিচের তার, আমাদের বিভিন্ন নেটওয়ার্ক ও পাইপলাইনের অবকাঠামোর তথ্য নিচ্ছে। এটিও জানি যে এগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলার জন্য নতুন সক্ষমতা তৈরি করছে দেশটি।’

র‍য়্যাল নেভির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জেনারেল গুইন জেনকিনস বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক ব্যয়ের পরও শত শত কোটি ডলার নিজেদের সাবমেরিন বহরে বিনিয়োগ করছে রাশিয়া। আটলান্টিকে রাশিয়ার চেয়ে এখনো এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে যতটা এগিয়ে থাকা দরকার, ততটা নয়।

রুশ হুমকি মোকাবিলায় রয়্যাল নেভির নতুন কৌশল কাগজ–কলমে ভালো মনে হলেও তা মুখোশ দিয়ে সমস্যা আড়াল করার মতো বলে উল্লেখ করেছেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান র‍য়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার রবার্টস। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম আটলান্টিকের অভিভাবক হওয়ার যে দায়িত্ব যুক্তরাজ্যের ছিল, তা অবহেলা করেছে দেশটি।

পিটার রবার্টস বলেন, রয়্যাল নেভির কাছে এ হুমকি মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত জাহাজ নেই। তারা হুমকিটিকে ড্রোনের মাধ্যমে মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কারণ, এগুলোর দাম কম। আর নতুন জাহাজ কেনার বদলে এগুলো দিয়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নজরদারি করা যায়। তবে এগুলো দিয়ে যুক্তরাজ্যের জলসীমায় রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়।