ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য নতুন সেনাসদস্য খুঁজছে রুশ সেনাবাহিনী। রাশিয়ার সব জায়গায় তাঁদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পোস্টার চোখে পড়ছে
ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য নতুন সেনাসদস্য খুঁজছে রুশ সেনাবাহিনী। রাশিয়ার সব জায়গায় তাঁদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পোস্টার চোখে পড়ছে

ইউক্রেন যুদ্ধের ৩ বছর: ‘ট্রাম্প একজন অপ্রত্যাশিত বিজয়ী’

টোভ্যার শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমেই আমি যা লক্ষ করলাম, সেটি হলো সেনাবাহিনী। সবখানেই তারা—বিলবোর্ডে, ভবনের পাশে, বাসস্টপেজে; ‘রাশিয়ার নায়ক’ লেখা বিভিন্ন প্রতিকৃতিতেও।

কালাশনিকভ রাইফেল হাতে সেনাদের পোস্টারে রাশিয়াকে ভালোবাসতে, দেশকে নিয়ে গর্ব করতে ও দেশকে রক্ষায় উৎসাহিত করা হয়েছে জনসাধারণকে। অন্য কথায়, সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে ও ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

ক্রেমলিন শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধকে যুদ্ধ না বলে বিশেষ সামরিক অভিযান বলে আসছে। রাশিয়ার অনেক মানুষের কাছে এ যুদ্ধ এমন একটি ঘটনা, যা তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখেছেন। কিন্তু অ্যানার মতো মানুষের কাছে এটি অনেক বেশি বাস্তব।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। যুদ্ধের তিন বছর পূর্তি আজ। তবে এত দিন পরও রাশিয়া নতুন করে সেনা নিয়োগের চেষ্টা করছে।

আপনি যদি টোভ্যারে থাকেন, তবে বুঝতে পারবেন, শহরের চারপাশে সামরিক দৃশ্যপট ফুটে ওঠা সত্ত্বেও মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। শহরটি সম্মুখসারির যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কয়েক শ মাইল দূরে।

মিখাইল নামের স্থানীয় একজন শিক্ষক বিবিসিকে বলেন, ‘আপনি শুধু চারপাশে তাকান। পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। দোকানপাট সব খোলা। কোনো গোলা এসে পড়ছে না। আমাদের মধ্যে নেই কোনো আতঙ্ক। সম্ভাব্য হামলার মুখে পড়া নিয়ে কোনো সাইরেনও শুনতে হচ্ছে না। ছুটতে হচ্ছে না কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে।’

ক্রেমলিন শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ না বলে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলে আসছে। রাশিয়ার অনেক মানুষের কাছে এ যুদ্ধ এমন একটি ঘটনা, যা তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখেছেন। কিন্তু অ্যানার মতো কারও কারও কাছে এটি অনেক বেশি বাস্তব।

আপনি শুধু চারপাশে তাকান। পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। দোকানপাট সব খোলা। কোনো গোলা এসে পড়ছে না। আমাদের মধ্যে নেই কোনো আতঙ্ক। সম্ভাব্য হামলার মুখে পড়া নিয়ে কোনো সাইরেনও শুনতে হচ্ছে না। ছুটতে হচ্ছে না কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে।
মিখাইল, রাশিয়ার নাগরিক  

বিবিসির প্রতিনিধির সঙ্গে রাস্তায় আলাপচারিতাকালে অ্যানা বলেন, ‘আমি এমন অনেক লোককে চিনি, যাঁরা যুদ্ধে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আর বাড়ি ফেরেননি। আমি চাই (এ যুদ্ধ) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হোক।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এমনটাই চান বলে দাবি করেছেন। ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে না ডেকে ট্রাম্প প্রশাসন এরই মধ্যে রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মস্কোর সঙ্গে তাঁর আলোচনা সম্পর্কে রুশদের মতামত কী—এ বিষয়ে অ্যানার মত, ‘(এ যুদ্ধে) ট্রাম্প একজন অপ্রত্যাশিত বিজয়ী। আমি জানি না তাঁর কাছ থেকে কী আশা করা উচিত।’

প্রসঙ্গত, রাশিয়ার সঙ্গে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইউক্রেনকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসনের দেওয়া শত শত কোটি ডলারের সহায়তা ফেরত চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গতকাল শনিবার ওয়াশিংটন ডিসির বাইরে নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির সদস্যদের বার্ষিক জমায়েতে এ কথা সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তাঁর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছেন তিনি। তবে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় ইউক্রেনকে যুক্ত করা হয়নি। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে কয়েক দফা আক্রমণাত্মক কথাও বলেছেন ট্রাম্প।

ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন রুশ সেনারা

এরই মধ্যে ইউক্রেনকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের দেওয়া সহায়তার অর্থ ফেরত নেওয়া প্রসঙ্গে কথা বললেন ট্রাম্প। গতকালের ওই জমায়েতে তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কাজ করছি। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কাজ করছি। আমি (সহায়তার) অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’

‘আমরা ইউক্রেনের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ চাই’

টোভ্যারে বিবিসি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁদের কেউ কেউ তিন বছর ধরে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে যে আনুষ্ঠানিক বর্ণনা শুনে আসছেন, তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর তা হলো তাঁদের দেশ আক্রমণকারী নয়। নিজেদের নাগরিক ও ইউক্রেনে রুশভাষীদের রক্ষা করছে রাশিয়া। রাশিয়া অঞ্চলটি দখল করছে না; বরং মুক্ত করছে।

তবে এর অর্থ এই নয় যে রাশিয়ার সমাজ সামগ্রিকভাবে এ ভাষ্য গ্রহণ করেছে। নিউজটাইমস ডট আরইউ ও নোভায়া গ্যাজেটার কলাম লেখক আন্দ্রেই কোলেসনিকভ মনে করেন, ‘একটি সমাজে মানুষ সব সময় মূলধারার সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে। যদি মূলধারা যুদ্ধের পক্ষে থাকে ও টেলিভিশনে বলা হয়, আমরা পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত, তবে একজন গড়পড়তা নাগরিক সেটাই মেনে নেবেন। আপনি শান্তিতে বসবাস করতে চাইলে কেন সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে যোগ দেবেন না?’
ল্যারিসা ও তাঁর স্বামী ভ্যালেরি স্বেচ্ছায় সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে। ল্যারিসা বলেন, ‘আমরা সবাই বিশেষ সামরিক অভিযানের পক্ষে। আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে ও সেখানে যেতে প্রস্তুত!’ যদিও তাঁরা স্পষ্টভাবে এখনো এসবের কিছুই করেননি।
ল্যারিসা আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি (রাশিয়া) জয়ী হবে। আমরা চাই, ইউক্রেন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করুক।’

বিবিসির সংবাদদাতা বলেন, ঠিক এমন সময় পুলিশ এসে হাজির হলো। তারা একটি ফোনকল পেয়ে এসেছে। কেউ তাদের বলেছে, সন্দেহভাজন লোকজন ক্যামেরা হাতে টোভ্যারে ঘোরাঘুরি করছেন। সন্দেহভাজন লোকজন বলতে আমাদের বোঝানো হয়েছে।

বিবিসির সংবাদদাতা আরও বলেন, পুলিশ ভদ্রভাবে আমাদের কাছে জানতে চাইল, আমরা কেন এখানে এসেছি। তারা আমাদের গাড়িচালকের বক্তব্য নেয়। আমাদের গাড়ি তল্লাশি করে। আমাদের কাছে এখানে আসার ব্যাখ্যা চায়। আমি তাদের বলি, আমরা মস্কোর বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা আমাদের নথিপত্র দেখাই, যা ঠিকঠাক ছিল।

ওই সংবাদদাতা বলেন, আমরা যখন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের একজন ক্যামেরা ক্রু এসে আমাদের ভিডিও করতে শুরু করেন। টেলিভিশনের প্রতিবেদক বললেন, ‘আমরা এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, পুলিশকে দেখতে পেলাম এবং আপনাকে চিনতে পারলাম। আপনি কি বলবেন, এখানে কী হচ্ছে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি জানি না। হয়তো আপনি আমাদের বলতে পারবেন এখানে কী হচ্ছে?’ আমি আরও বললাম, ‘আপনি কী ভিডিও করছেন? আমরা রাস্তায় লোকদের সঙ্গে কথা বলছি। আমার বিশ্বাস, আমাদের এটা করার অনুমতি আছে।’ উত্তরে ওই প্রতিবেদক বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের দেশে বাক্‌স্বাধীনতা আছে। হয়তো পুলিশ আপনাকে শুধু সহযোগিতা করতে চায়। পশ্চিমা টেলিভিশনে রাশিয়ায় বাক্‌স্বাধীনতা নেই বলে যে ভুয়া খবর ছড়ানো হয়, তা শুনতে খারাপ লাগে। আপনি মানুষের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কথা বলছেন। কেউ আপনাকে বাধা দিচ্ছে না।’ আমি তাঁর দিকে ইশারা করে বললাম, ‘আপনি ও আমাদের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা বাদে।’

এ ঘটনা প্রায় এক ঘণ্টা চলল। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার ভেতরে অবস্থানরত পশ্চিমাদের নিয়ে সন্দেহ তীব্র আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্কে বরফ গলার প্রাথমিক লক্ষণ এখনো সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।

টোভ্যারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হওয়া গেছে যে যুদ্ধের অবসান অর্থনৈতিক স্বস্তি বয়ে আনবে বলে প্রত্যাশা করছেন রুশরা।

ইউলিয়া তাঁর বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য দোলাতে দোলাতে বলেন, ‘আলু ও পেঁয়াজের মতো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দাম এখন অনেক বেশি। আমি সত্যিই তা অনুভব করছি।’

তবে শিক্ষক মিখাইল মনে করেন না যে শান্তি নিশ্চিত করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে কোনো কৌশল আছে। তাঁর বিশ্বাস, ‘দুর্ভাগ্যবশত ট্রাম্পের কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি জানেন না, কী করবেন। তাঁর প্রতি আমার সহানুভূতি। আমি খুশি, তিনি জিতেছেন। কিন্তু কাহিনির এ পর্বে আমরা সবাই অন্ধকারে।’