
মাটিধসে ঝুঁকিতে পড়া ১১৩ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক একটি গির্জাকে না ভেঙে পুরোপুরি স্থানান্তর করা হচ্ছে। সুইডেনের উত্তরাঞ্চলের একটি সড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে গির্জাটিকে।
সুইডেনের কিরুনায় ১৯১২ সালে নির্মিত লাল কাঠের বিশাল এই গির্জাকে বড় একটি ট্রেলারের ওপর তোলা হয়েছে। এটি ধীরে ধীরে নতুন শহরের পথে যাত্রা করছে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫০০ মিটার গতিতে চলা এই যাত্রা শেষ হতে দুই দিন লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে লৌহ আকরিক খনির খননকাজের কারণে সৃষ্ট ভূমিধস ও ফাটলের ঝুঁকিতে আছে পুরোনো শহরের কেন্দ্রস্থল। কিরুনার ভবনগুলোর স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে গির্জার স্থানান্তর সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনা। শহরটি আর্কটিক সার্কেলের ১৪৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
গির্জার ভিকার লেনা জার্নবার্গ ও লুলেয়ো ডায়োসিসের বিশপ আশা নাইস্ট্রোমের আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই গির্জা স্থানান্তরের যাত্রা শুরু হয়। সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে ট্রেলারের ইঞ্জিন চালু হয়ে বিশাল কাঠের গির্জাটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগোতে শুরু করে। প্রথম ঘণ্টায় এটি মাত্র ৩০ মিটার অগ্রসর হয়েছে। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এই ব্যতিক্রমী ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন।
সুইডেনের সাংস্কৃতিক কৌশলবিদ সোফিয়া লাগারলোফ মাত্তা বলেন, ‘এটা বিশাল জনসমাগম। শুধু কিরুনা বা সুইডেনের বিভিন্ন জায়গা থেকেই নয়, নানা ভাষার মানুষ এখানে এসেছেন। মনে হচ্ছে, যেন চোখের সামনে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে।’
স্থানান্তরের কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকল্প ব্যবস্থাপক স্টেফান হোমব্লাড জোহানসন বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বিশাল ও জটিল কাজ এবং এখানে কোনো ভুলের সুযোগ নেই। তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে।’
২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কিরুনার অন্যান্য ভবন নিরাপদ এলাকায় সরানো শুরু হয়। বেশির ভাগ ভবন ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, তবে কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা হুবহু অক্ষত সরানো হয়েছে।
এর মধ্যে আছে ইয়ালমার লুন্ডবোমসগার্ডেনের হলুদ সারির তিনটি পুরোনো কাঠের বাড়ি ও খনির ব্যবস্থাপক ইয়ালমার লুন্ডবোমের বাসা। এগুলো তিন ভাগে কেটে সরানো হয়েছিল। পুরোনো সিটি হলের ছাদের ক্লক টাওয়ারটিও সরিয়ে নতুন সিটি হলের পাশে বসানো হয়েছে।
সুইডিশ আইনে কোনো ভবনের নিচে খননকাজ করার অনুমতি নেই। কিরুনার একটি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রবার্ট ইলিতালো বলেন, ‘মানুষ হঠাৎ ফাটলের মধ্যে পড়ে যায়, বিষয়টি এমন নয়। সময়ের সঙ্গে ফাটলগুলো পানি, বিদ্যুৎ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবকাঠামো ধসে পড়ার আগে মানুষকে সরিয়ে আনতে হবে।’
লৌহ আকরিক খনির অপারেটর ও কিরুনার সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা এলকেএবি পুরো শহর স্থানান্তরের খরচ বহন করছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার কোটি সুইডিশ ক্রোনা (প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭৩৭ মিলিয়ন পাউন্ড)।
কিরুনা গির্জার উচ্চতা ৩৫ মিটার (১১৫ ফুট), প্রস্থ ৪০ মিটার ও ওজন ৬৭২ টন। এটি একসময় সুইডেনে ১৯৫০ সালের আগের সবচেয়ে সুন্দর ভবন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
এত বড় ভবন স্থানান্তর একটি জটিল বিষয়। তবে ভবনটিকে না ভেঙে প্রকৌশলীরা পুরো ভবনটি একসঙ্গে অক্ষত অবস্থায় সরিয়ে নিচ্ছেন। এটি সরানো হচ্ছে ইস্পাত বিমের ওপর ভর করে স্বচালিত মডুলার ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে।
জোহানসন বলেন, ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাস্তা প্রস্তুত করা, যাতে এত বড় ভবন পার হতে পারে। আমরা রাস্তা ২৪ মিটার (৭৯ ফুট) প্রশস্ত করেছি। রাস্তা থেকে ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক লাইট সরানো হয়েছে, এমনকি একটি সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে।’
গির্জা স্থানান্তরের প্রক্রিয়া দেখতে গোথেনবার্গ থেকে গাড়ি চালিয়ে সেখানে গেছেন লেনা এডকভিস্ট ও তাঁর স্বামী। লেনা বলেন, ‘আমি বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া গির্জায় যাই না। তবে এটি আমার ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ। ওরা না ভেঙে গির্জাটি পুরোপুরি সরাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গৌরবের।’
ভেইডেক্কে নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক কিয়েল ওলভসন বলেন, ‘বছরের পর বছর প্রস্তুতির পর অবশেষে আমরা এগোতে শুরু করেছি। আমি আনন্দিত এবং মুহূর্তটা উপভোগ করছি। আবহাওয়া ভালো, আর আমি নিশ্চিত সবকিছু নির্বিঘ্নে চলবে।’
অক্ষত অবস্থায় গির্জা স্থানান্তরে সবচেয়ে সংবেদনশীল কাজগুলোর একটি হলো, গির্জার ভেতরের ঐতিহাসিক সম্পদ রক্ষা করা, বিশেষ করে সুইডিশ রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স ইউজেনের আঁকা বিশাল বেদিচিত্র।
স্থানান্তরের কাজের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জোহানসন বলেন, ‘এটা এমন কিছু নয়, যেটা হুক থেকে নামিয়ে নেওয়া যায়। এটা সরাসরি ইটের দেয়ালে আটকানো, তাই ক্ষতি ছাড়া সরানো যেত না। এ জন্য স্থানান্তরের সময় ছবিটি গির্জার ভেতরেই ঢাকা থাকবে।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই স্থানান্তর বিস্ময়ের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটি গভীর আবেগঘন মুহূর্ত। সোফিয়া লাগারলোফ মাত্তা বলেন, ছোটবেলায় তিনি দাদির হাত ধরে প্রথমবারের মতো গির্জায় গিয়েছিলেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গির্জাটি ছিল আত্মিক কেন্দ্র ও মিলনস্থল।
মাত্তা আরও বলেন, ‘এই স্থানান্তর আমাদের আনন্দ ও বেদনার স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে এনেছে। আর আমরা সেই স্মৃতিগুলো সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি অন্য শহরে।’
স্থানান্তরের কাজের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জোহানসন একজন প্রকৌশলী। তিনি গির্জার গসপেল সংগীত দলেরও সদস্য। নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এটি একেবারেই বিশেষ কাজ। ১০০ বছর আগে গির্জাটি এলকেএবি পৌরসভার জন্য তৈরি করেছিল। এখন আমরা এটিকে নতুন শহরে সরিয়ে নিচ্ছি। আর কোনো বিকল্প ছিল না।’
সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হলে গতকাল বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে গির্জাটি নতুন শহরের কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়ার কথা।