
দুই সন্তানের প্রাণ গেছে বোমা হামলায়। গুরুতর আহত আরেক সন্তান। তাদের নিয়ে বসে আছেন মা। এই মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
আজারবাইজানের নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে বোমা হামলার ঘটনায় তিন শিশুসহ নিহত হয়েছেন পাঁচজন। আজারবাইজান বলছে, কেবল সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে তারা ওই হামলা চালিয়েছিল।
আজারবাইজানের নাগোরনো-কারাবাখের আসকেরান অঞ্চলের সরানাগবুর (আজারবাইজানের ভাষায় আগবুলাগ) গ্রামটি জঙ্গলে ঘেরা। গ্রামটি সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হবে—এমনটা কেউ ভাবতেই পারেননি।
আসকেরানের পার্শ্ববর্তী একটি শহরে জেরিন গাজারিয়ানের বসবাস করেন। ১৯ সেপ্টেম্বর শহরটিতে আকস্মিক অভিযান চালায় আজারাইজান। ওই দিন ছোট ছেলে কারেনের জন্য খাবার কিনতে বের হয়েছিলেন জেরিন। প্রায় ৯ মাস ধরে জেরিনের মতো অসংখ্য আর্মেনীয় সেখানে আটকে ছিলেন। এতে শহরটিতে খাদ্য, জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়।
ওই দিন বিস্ফোরণের শব্দ শুনে বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করেন জেরিন। কিন্তু মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এ সময় কেউ একজন জানান, বিস্ফোরণে তাঁর ছেলে কারেন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।
কারেনকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর্মেনীয়দের কাছে জায়গাটি একটি সুপারমার্কেট হিসেবেই বেশি পরিচিত। জেরিনের তিন ছেলেকে রাশিয়ার শান্তিরক্ষী বাহিনী উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারেন, বিস্ফোরণে তাঁর দুই ছেলে ৮ বছরের মিখায়েল ও ১০ বছরের এনভার মারা গেছে।
হাসপাতালে যাওয়ার পর দুই সন্তানের নিথর দেহ দেখতে পান জেরিন। বিস্ফোরণে তাদের মাথায় মারাত্মক জখম হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের দেখেছি। তাদের অবস্থায় ভয়ংকর। এখন তাদের বাবা আসার অপেক্ষায় আছি।’
বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণের সময় এই শিশুদের সঙ্গে ছিল ওই গ্রামের কিশোর আরমান। হামলায় তার পিঠ, কাঁধ ও হাতে জখম হয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় বসে কথা হয় তার সঙ্গে।
আরমান বলে, ‘তারা চতুর্দিকে বোমাবর্ষণ শুরু করে। এতে অনেকেই প্রাণ হারায়, কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়। আমি অনেকের মাথা উড়ে যেতে দেখেছি। এ এক ভয়ানক দৃশ্য।’
একপর্যায়ে আরমানের পাশে তিনটি গোলা এসে পড়ে। সে বলে, ‘নিরাপত্তার জন্য শিশুদের একটি গাছের নিচে জড়ো করি। কিন্তু তারা সেখানেও বোমাবর্ষণ করে।’
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই দিনের হামলায় আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। গ্রামের মেয়র গরিক আলেক্সানিয়ান তাঁর ছেলে ডেভিড, বাবা আলেক্সান্দার ও শাশুড়ি গহরকে হারিয়েছেন। তিনি ছেলের মৃত্যুর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, সেদিনের হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ গ্রামবাসী। অসংখ্য মানুষকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তবে ওই দিনের হামলার ঘটনা বিবিসির পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
হামলার কারণে হাজার হাজার জাতিগত আর্মেনীয় গৃহহীন হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁরাও যোগ দিয়েছেন, যাঁদের অনেকেই স্টেপানাকার্ট শহরে এবং রাশিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় স্থানীয় বিমানবন্দরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা আশা করছেন, তাঁদের আর্মেনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে; যদিও তাঁরা এখনো বিমানবন্দরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
সন্তানহারা জেরিনের শেষ ইচ্ছা, তাঁর দুই ছেলেকে আর্মেনিয়ায় সমাহিত করবেন। কিন্তু এখন আর্মেনিয়া থেকে শুধু আহত ব্যক্তিদের উড়োজাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার সড়কপথে আর্মেনিয়ায় যাওয়ার রাস্তাতেও গাড়ির জট। তাই তাঁকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত এলচিন আমিরবেকভ বলেছেন, আজারবাইজানের সেনাবাহিনীকে আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরস্ত্রীকরণ করতে বলা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ‘কোনো সাধারণ মানুষের ক্ষতি করার ইচ্ছা আমাদের কখনো ছিল না। তবে এটা সত্য যে অভিযানে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে কোনো বেসামরিক মানুষ মারা গেলে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’
তবে বেসামরিক লোকদের ওপর নির্বিচার হামলা চালানো হয়েছে—এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন এলচিন আমিরবেকভ। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকে আর্মেনীয় সেনারা হাজার হাজার আজারবাইজানিকে উচ্ছেদ করেছিলেন। ওই সময় তাঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছিলেন।
নাগোরনো–কারাবাখ নিয়ে অনেক বছর ধরে বৈরী সম্পর্ক আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে। পার্বত্য অঞ্চল নাগোরনো–কারাবাখ সোভিয়েত আমলে আজারবাইজানের অংশ ছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এক যুদ্ধে আর্মেনিয়ার সহায়তায় জাতিগত আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অঞ্চলটি দখল করে নেন।