
২০১১ সালের দিকের কথা। একদল কিশোর স্কুলের খেলার মাঠের দেয়ালে স্প্রে দিয়ে ‘এবার আপনার পালা, ডাক্তার’ লেখা একটি সতর্কবার্তা লিখেছিল। এই গ্রাফিতি ছিল সম্ভবত তৎকালীন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের প্রতি একধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি। মূলত এটি দিয়ে বোঝানো হয়েছিল, আরব বসন্তে উৎখাত হওয়া আরব স্বৈরশাসকদের তালিকার পরবর্তী ব্যক্তি হতে যাচ্ছেন তিনি। বাশার লন্ডনে চক্ষুবিজ্ঞানে পড়ালেখা করেছেন।
অবশ্য আরব বসন্তের সেই পতিত স্বৈরশাসকদের তালিকায় বাশার আল–আসাদের নাম উঠতে ১৪ বছর লেগেছে। আর এর মধ্যে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। শেষ পর্যন্ত সেই ‘ডাক্তারের’ পালা এসেছে, আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে রাতের আঁধারে রাশিয়ার মস্কোয় পালিয়ে গেছেন।
তবে মস্কোতে বিলাসবহুল নির্বাসিত জীবনের মধ্যে নিজের স্বৈরশাসনকে এক পাশে ঠেলে বাশার আবারও তাঁর চক্ষু চিকিৎসা পেশায় ফেরার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের শেষ বাথপন্থী শাসনব্যবস্থার নেতা এখন শ্রেণিকক্ষে বসে চক্ষুবিদ্যার পাঠ নিচ্ছেন—এমনটাই জানিয়েছে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
সিরিয়ায় আসাদ সরকার উৎখাতের পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা মস্কো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিরিবিলি ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
বাশার আল–আসাদ পরিবারের একজন বন্ধু এখনো তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বলেছেন, ‘আসাদ রুশ ভাষা শিখছেন। পাশাপাশি নিজের চক্ষুবিদ্যার পড়াশোনাও ঝালিয়ে নিচ্ছেন। এটা তাঁর পছন্দের বিষয়। তাঁর অর্থের প্রয়োজন নেই, সেটা স্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরুর আগেও তিনি দামেস্কে নিয়মিত রোগী দেখতেন।’ মস্কোর ধনী অভিজাত ব্যক্তিরা হয়তো আবার তাঁর রোগী হতে পারেন বলে ইঙ্গিত দেন ওই ব্যক্তি।
সিরিয়ায় আসাদ সরকার উৎখাত হওয়ার এক বছর পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা মস্কো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিরিবিলি ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। দুনিয়ার অন্য সবকিছু থেকে তাঁরা এখন একরকম বিচ্ছিন্ন। বাশার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, রাশিয়া ও সিরিয়ার একাধিক সূত্র এবং ফাঁস হওয়া কিছু তথ্য একসময় শক্ত হাতে সিরিয়া শাসন করা প্রেসিডেন্টের অন্তরালের জীবনযাপন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে সাহায্য করেছে।
এ বিষয়ে জানত এমন অন্তত দুটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাশার পরিবার সম্ভবত মস্কোর অভিজাত রুবলিওভকা এলাকায় বসবাস করছে। সেখানে তারা ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের মতো নেতাদের প্রতিবেশী। ইয়ানুকোভিচ ২০১৪ সালে কিয়েভ ছাড়েন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিও ওই এলাকায় বসবাস করেন।
আসাদ পরিবারের অর্থের কোনো অভাব নেই। ২০১১ সালে বিক্ষোভ ঠেকাতে আসাদ সরকার বিরোধীদের ওপর কঠোর দমন–পীড়ন চালায়। ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনেক অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সিরিয়া। এর পর থেকে পরিবারটি তাদের বেশির ভাগ সম্পদ মস্কোয় পাচার করত। ফলে পশ্চিমারা ওই সম্পদে হাত দিতে পারেনি।
আরামদায়ক ও বিলাসী জীবনযাপনের পরও বাশার পরিবার অভিজাত সিরীয় ও রুশ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। সিরিয়া থেকে শেষ মুহূর্তে বাশারের পালিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর অনুগামীদের মধ্যে তিক্ত অনুভূতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে রুশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সিরিয়া সরকারের সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাধা দিচ্ছে।
বাশার পরিবারের একজন বন্ধু বলেন, ‘এটা খুবই নিরিবিলি একটা জীবন। বাইরের জগতের সঙ্গে বাশারের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তিনি মূলত তাঁর প্রাসাদে থাকা কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। যেমন মনসুর আজম (সিরিয়ার সাবেক মন্ত্রী) ও ইয়াসার ইব্রাহিম (আসাদের প্রধান অর্থনৈতিক সহযোগী)।’
ক্রেমলিনের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, পুতিন ও রাশিয়ার রাজনৈতিক অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে বাশার আল–আসাদ এখন ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়েছেন। সূত্রটি বলেছে, ক্ষমতাচ্যুত নেতাদের প্রতি পুতিনের আগ্রহ কম। তা ছাড়া বাশারকে এখন আর প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এমনকি নৈশভোজে আমন্ত্রণ করার মতো অতিথি হিসেবেও তাঁকে বিবেচনা করা হয় না।
বিদ্রোহী বাহিনীর ভয়ে ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর সন্তানদের নিয়ে দামেস্ক থেকে পালিয়ে মস্কোতে যান আসাদ। তবে দামেস্ক থেকে তাঁকে প্রথমে রুশ সামরিক বাহিনী নিরাপত্তা দিয়ে সিরিয়ায় রুশ বাহিনী পরিচালিত খেমিইমিম বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যায়।
বাশার তাঁর বৃহৎ পরিবার কিংবা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের আসন্ন পতন সম্পর্কে সতর্ক করেননি; বরং তাঁদের পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেন।
ক্রেমলিনের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, পুতিন ও রাশিয়ার রাজনৈতিক অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে আসাদ ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে গিয়েছেন। কারণ, ক্ষমতাচ্যুত নেতাদের প্রতি পুতিনের আগ্রহ কম।
মস্কোয় পালানোর পর প্রথম কয়েক মাসে সাবেক সহযোগীদের কথা বাশারের মাথায় ছিল না। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত সিরিয়ার সাবেক ফার্স্ট লেডি আসমার পাশে থাকার জন্য পরিবারের সদস্যরা মস্কোতে এসেছিলেন। আসমা অনেক বছর ধরে লিউকেমিয়ায় ভুগছেন। তাঁর অবস্থা ক্রমে সংকটজনক হয়ে উঠছে। আসাদ সরকারের পতনের আগে তিনি মস্কোতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
আসমার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানে এমন একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক ফার্স্ট লেডি রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থার তত্ত্বাবধানে থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
আসমার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার পর সাবেক এই স্বৈরশাসক তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলা শুরু করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি ও একজন জনপ্রিয় মার্কিন ডানপন্থী পডকাস্টারকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ও দিয়েছেন। এখন রুশ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন। সেই অনুমোদন পাওয়া যাবে কি না, এখনো নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।
সম্ভবত রাশিয়া বাশারকে জনসমক্ষে হাজির হতে নিষেধ করেছে। নভেম্বরে মস্কোয় আসাদের জীবনযাপন সম্পর্কে ইরাকের গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ হওয়ার পর ইরাকে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এলব্রুস কুত্রাশেভ নিশ্চিত করেছেন, পতিত স্বৈরশাসককে প্রকাশ্য কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তবে বাশারের সন্তানদের জীবনযাপনে তুলনামূলকভাবে ঝক্কিঝামেলা তেমন একটা হয়নি। কারণ, তাঁরা মস্কোর অভিজাত সমাজে নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন।
পরিবারটির এক বন্ধু কয়েক মাস আগে বাশারের সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘তারা কিছুটা বিস্মিত। মনে হচ্ছে তারা এখনো মানসিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। তারা এখন সিরিয়ার প্রথম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে না থাকা জীবনকে মানিয়ে নিচ্ছে।’
বাশারের পতনের পর তাঁকে ছাড়া পরিবারের সদস্যদের শুধু একবারই জনসমক্ষে একসঙ্গে দেখা গেছে গত ৩০ জুন। ওই দিন তাঁর মেয়ে জেইন আল-আসাদের স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান ছিল। তিনি এমজিআইএমও থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন। এমজিআইএমও হলো মস্কোর একটি অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে রাশিয়ার শাসকশ্রেণির অনেকের সন্তান পড়াশোনা করেন।
এমজিআইএমওর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি ছবিতে ২২ বছর বয়সী জেইনকে অন্য স্নাতক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। অনুষ্ঠানের একটি ঝাপসা পৃথক ভিডিওতে দেখা গেছে, আসাদের স্ত্রী আসমা এবং দুই ছেলে হাফেজ (২৪) ও করিম (২১) দর্শকের আসনে বসে আছেন।
ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত জেইনের দুজন সহপাঠী নিশ্চিত করেছেন, আসাদ পরিবারের কয়েকজন সদস্য সেদিন উপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁরা খুব চুপচাপ ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সহপাঠী বলেন, ‘পরিবারটি বেশি সময় থাকেনি। এমনকি অন্যান্য শিক্ষার্থীর পরিবারের মতো জেইনের সঙ্গে মঞ্চে কোনো ছবিও তোলেনি।’
হাফেজকে একসময় বাশারের সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে একটি টেলিগ্রাম ভিডিও পোস্ট করার পর থেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন তিনি। ওই ভিডিওতে তিনি তাঁর পরিবারের দামেস্ক ছাড়ার ঘটনা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেন। তিনি দাবি করেন, তাঁরা তাঁদের সহযোগীদের ছেড়ে আসেননি; বরং তাঁদের সিরিয়া ছাড়ার নির্দেশ মস্কো থেকেই এসেছিল।
ওই ভিডিও দেখার পর সিরিয়ার নাগরিকেরা সঙ্গে সঙ্গেই হাফেজের অবস্থান শনাক্ত করেন। তিনি মস্কোর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভিডিওটি ধারণ করেছিলেন।
ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাফেজ তাঁর বেশির ভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপর একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করে নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছেন।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাশারের সন্তানেরা ও তাঁদের মা আসমা কেনাকাটা করেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেন। তাঁদের নতুন রুশ বাড়িটি বিলাসবহুল জিনিসপত্র দিয়ে পূর্ণ করেছেন।
রাশিয়া থেকে ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেইন আল-আসাদ নিয়মিত দামি পোশাক কেনেন। তিনি অভিজাত একটি পেডিকিউর সেলুনে নাম লিখিয়েছেন। মস্কোর একটি অভিজাত জিমেরও সদস্য তিনি।
বাশারের সন্তানেরা নিয়মিত সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। অন্তত একবার তাঁর স্ত্রী আসমাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৭–২৩ সালের ফাঁস হওয়া ফ্লাইট রেকর্ড অনুযায়ী, ক্ষমতায় থাকাকালেও আসাদ পরিবারের প্রিয় গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়েছিল আরব আমিরাত।
করিম ও হাফেজ বারবার আবুধাবি, মস্কো ও সিরিয়া সফর করেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের নভেম্বর ও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের ফ্লাইটও রয়েছে।
পরিবারের একজন সদস্যের ভাষ্য, প্রথম দিকে বাশার পরিবার মস্কোর চেয়ে বরং সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) চলে যেতে চেয়েছিল। আমিরাত তাদের জন্য অনেক বেশি আপন জায়গা ছিল। তারা রুশ ভাষা জানত না। এমনকি রুশ সমাজের মধ্যে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতেও কষ্ট হচ্ছিল।
তবে পরিবারটি এখন বুঝতে পারছে, স্থায়ীভাবে রাশিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া সময়সাপেক্ষ বিষয়। কারণ, সংযুক্ত আরব আমিরাতও বাশার ও তাঁর পরিবারকে আতিথ্য দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। যদিও বিশ্বের অন্ধকার জগতের অনেক অভিজাত ব্যক্তি সেখানে বসবাস করেন।