
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সোমবার বলেছেন, ‘রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে একটি শান্তিচুক্তি করার পথে এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।’ জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ইউরোপীয় নেতা ও মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠকের পর তিনি এ কথা বলেন।
বার্লিনে দুই দিনের উচ্চপর্যায়ের ওই বৈঠকের পর কূটনীতিকেরা অন্য জটিল বিষয়গুলোর মধ্যে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ সামরিক হুমকি থেকে ইউক্রেনকে কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়েছিল ইউক্রেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল ও ২০২২ সালে রাশিয়ার হামলা ঠেকানো যায়নি।
বৈঠকের আগে জেলেনস্কি বলেন, পশ্চিমা সামরিক জোটে (ন্যাটো) যোগ দেওয়ার আশা ত্যাগের বিনিময়ে ইউক্রেন আইনি বাধ্যবাধকতার সঙ্গে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলে তাদের তৎপরতা আরও বাড়বে, এমন যুক্তি দেখিয়ে রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা চালায়।
তবে ইউরোপের নেতারা বলেছেন, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে ভূখণ্ড–সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতপার্থক্যের সমাধান হয়নি এখনো। তাই প্রশ্ন উঠছে, একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি শেষ পর্যন্ত সম্ভব কি না?
বার্লিন বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হলো
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার বার্লিন বৈঠকে অংশ নেন। ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর প্রধান নেতারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে ইউরোপীয় নেতারা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরা ইউরোপের নেতৃত্বে একটি ‘বহুজাতিক বাহিনী’ গঠনের প্রস্তাব দেন। ওই বাহিনীকে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই বাহিনী ইউক্রেনের ভেতরে কাজ করবে। পাশাপাশি ইউক্রেনের বাহিনীকে সহায়তা করা, আকাশসীমার নিরাপত্তা দেওয়া এবং নিরাপদ জলসীমা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ইউক্রেনের সুরক্ষা প্রস্তাবটি ন্যাটোর ‘অনুচ্ছেদ–৫’–এর আদলে করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো সদস্যদেশের ওপর হামলা হলে সবার ওপর হামলা হিসেবে গণ্য হবে।
আমরা ইউরোপিয়ান নেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছি। তারা এই যুদ্ধ শেষ করতে চাইছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। আমি মনে করি আমরা এখন চুক্তির যতটা কাছাকাছি পৌঁছেছি, তা আগে কখনো হয়নিডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট
বার্লিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জেলেনস্কি বলেন, সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির আওতায় ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিয়েভের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। নিশ্চয়তায় কার্যকর যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের বিষয়টি থাকতে হবে।
তবে কীভাবে এ ধরনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বেশ সতর্ক। কারণ, ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়েছিল ইউক্রেন। তা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল ও ২০২২ সালে রাশিয়ার হামলা ঠেকানো যায়নি।
জার্মান চ্যান্সেলর ফেডরিখ মার্ৎস বলেছেন, বৈঠকে ওয়াশিংটন উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তার প্রস্তাব দিয়েছে। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আইনি ও ভৌত নিশ্চয়তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র যা তুলে ধরেছে, তা সত্যিই উল্লেখ করার মতো।
তবে রাশিয়া এ প্রস্তাবের বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ইউরোপীয় নেতাদের নিয়ে কড়া ভাষায় কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও নিজের কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট বুধবার বলেছেন, কূটনীতির মাধ্যমে বা সামরিক শক্তি খাটিয়ে—যেভাবেই হোক না কেন, ইউক্রেনে নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করবে মস্কো।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প কী বলেছেন
গত সোমবার ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ইউরোপীয় নেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছি। তারা এই যুদ্ধ শেষ করতে চাইছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, আমরা এখন চুক্তির যতটা কাছাকাছি পৌঁছেছি, তা আগে কখনো হয়নি। এখন দেখব আমরা কী করতে পারি।’
বর্তমানে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পিছু হটা ও সামরিক সহায়তা কমে যাওয়ায় তাদের সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে ধীরে ধীরে রাশিয়া আরও ভূখণ্ড দখল করছে।
জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এ জন্য ইউক্রেনকে কিছু বিষয়ে ছাড় দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন।
জেলেনস্কি কী বলেছেন
উইটকফ ও কুশনারের সঙ্গে বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে সোমবার জেলেনস্কি এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘এ ধরনের বৈঠক আগে হলে আরও বেশি অগ্রগতি হতো। ভূখণ্ড–সংক্রান্ত বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের ভিন্ন অবস্থান। এটি স্বীকার করতে হবে এবং এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা উচিত। আমি বিশ্বাস করি, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প প্রস্তাব করবে, যাতে অন্তত একমত হওয়া যায়।’
জেলেনস্কি আরও বলেন, ‘আমরা ভূখণ্ড ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং ইউক্রেনকে পুনর্গঠনের জন্য ক্ষতিপূরণের অর্থসহ সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পেতে সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালাব। এই অর্থের উৎস সম্পর্কে জানাটা খুব জরুরি।’
আগে ইউক্রেন ইঙ্গিত দিয়েছিল, পশ্চিমা নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে তারা ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার আশা ত্যাগ করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনও কিয়েভের ন্যাটো সদস্যপদের বিরোধী ছিল।
ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, শান্তিচুক্তি খুব কাছাকাছি। তবে সেটি স্থায়ী কোনো চুক্তি ছাড়াইকিয়ার জাইলস, সামরিক বিশেষজ্ঞ, চাথাম হাউস
জেলেনস্কি বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করছি। যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সেনাবাহিনী এবং সাধারণ মানুষ—সবার স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কেমন হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তবে ইউক্রেন কী ধরনের বিশেষ নিরাপত্তা পাবে এবং কোন কোন দেশ নিরাপত্তা প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে, তা এখনো অস্পষ্ট।
যুদ্ধবিরতি কি সত্যিই ‘খুব সন্নিকটে’
লন্ডনের চিন্তক প্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের রাশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞ কিয়ার জাইলস আল–জাজিরাকে বলেন, ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, শান্তিচুক্তি খুব কাছাকাছি, তবে সেটি স্থায়ী কোনো চুক্তি ছাড়াই।
ইতালির ইস্তিতুতো আফারি ইন্টারনাজিওনালির পরিচালক টোকসি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির সম্ভাবনা একদম কম। আমার মনে হয়, চলমান যুদ্ধ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা বেশি।’ এর কারণ ভূখণ্ড ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ের সমাধান এখনো হয়নি।
বর্তমানে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পিছু হটা ও সামরিক সহায়তা কমে যাওয়ায় তাদের সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে ধীরে ধীরে রাশিয়া আরও ভূখণ্ড দখল করছে। এর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে রাশিয়া।
চাথাম হাউসের কিয়ার জাইলস বলেছেন, এখনো কয়েকটি দিক থেকে আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে। একটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে, আরেকটি ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে। তবে এসব উদ্যোগ সমন্বিতভাবে চলছে—এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই।
জাইলস আরও বলেন, কোনো বিষয়ে সমঝোতা হলেই রাশিয়া তা মেনে নেবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। এমনকি যেসব বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে, সেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য কি না—সেটিও নিশ্চিত নয়। যুদ্ধবিরতির মূল শর্ত আগের মতোই রয়ে গেছে। রাশিয়া তখনই যুদ্ধ বন্ধে রাজি হবে, যখন তারা মনে করবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে যুদ্ধবিরতিতে তাদের লাভ বেশি হবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে
জাইলস বলেন, এই যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে—এর উত্তর সব সময় যেমন ছিল, এখনো তেমনই রয়েছে। একদিকে রাশিয়াকে পিছু হটতে বাধ্য করা, অন্যদিকে ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।
জাইলস বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন একই শর্তে যুদ্ধবিরতিতে একমত হতে পারছে না। কারণ, তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের লক্ষ্য এতটাই ভিন্ন যে আধুনিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রমী।
এই বিশ্লেষক বলেন, ট্রাম্প একাধিকবার ক্রেমলিনের অনেক দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন। যার মধ্যে ইউক্রেনকে ভূখণ্ড ছাড় দেওয়ার দাবিও রয়েছে। যুদ্ধ শেষ করতে ট্রাম্পের প্রাথমিক ২৮ দফা পরিকল্পনায় রুশ যুদ্ধাপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার একটি ধারা ছিল। যদিও জেলেনস্কি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।
জাইলস বলেন, ট্রাম্পের ২৮ দফা পরিকল্পনা ইউরোপীয় নেতাদের বিরোধিতার কারণে সংশোধন করা হয়েছে। রাশিয়া মনে করছে, এটি তাদের জন্য সুবিধাজনক নয়।
জাইলস আরও বলেন, ‘রাশিয়া শুধু তখনই যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেবে, যখন তারা বিশ্বাস করবে যে চুক্তিটি ইচ্ছামতো লঙ্ঘন করা যাবে। সেই সুযোগ আবার যুদ্ধ শুরু করার জন্য সুবিধাজনক হবে।’