শুধু চীনেই উৎপাদিত হয় বিশ্বের অর্ধেক আপেল

বিশ্বে যেসব ফলের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়, তার একটি আপেল। স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে আপেলের সুনাম পৃথিবীজোড়া। সুস্বাদু এই ফলটির অনেক ধরন রয়েছে। আপেলের এর আদি বাড়ি মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকেই সারা বিশ্বে আপেল ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশে আপেলগাছ আছে। তবে মাটি, আবহাওয়া এবং অন্যান্য কারণে সব দেশে একই পরিমাণে আপেল উৎপাদন হয় না। সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদনকারী দেশ চীন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) করা সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, আপেল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা ১০ দেশ নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।

চীন

চীনের লু চুয়ান কাউন্টিতে একটি আপেল বাগান থেকে আপেল তুলছেন পর্যটকেরা
ফাইল ছবি: সিনহুয়া

আপেল উৎপাদনে শীর্ষ দেশ চীন। এশিয়ার এই দেশটিতে বছরে ৪ কোটি ৭০ লাখ টনের বেশি আপেল উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে বেশি তাজা আপেল রপ্তানিকারক দেশও চীন। এ ছাড়া এই দেশেই সবচেয়ে বেশি অঞ্চলজুড়ে আপেলবাগান রয়েছে। ২০২০ সালে বিশ্বে মোট উৎপাদিত আপেলের ৫৩ দশমিক ২০ শতাংশই এসেছে চীন থেকে। পরের বছর চীন প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টন আপেল উৎপাদন করে।
চীনের যেসব অঞ্চলে আপেলবাগান আছে, তার বেশির ভাগ এলাকায় কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস এই আপেল। চীনে মূলত বোহাই বে এবং লোয়েস/লোস মালভূমিতে সবচেয়ে বেশি আপেল চাষ হয়। চীনের আপেলবাগানের প্রায় ৮০ শতাংশই এই দুই অঞ্চলে। দেশটিতে মোট উৎপাদিত আপেলের ৯০ শতাংশ ওই দুই অঞ্চল থেকে আসে।

তুরস্ক

তুরস্কের ইস্তাম্বুলের একটি ফল বাজার

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আপেল উৎপাদনকারী দেশ তুরস্ক। ২০২২ সালে দেশটি প্রায় ৪৮ লাখ টন আপেল উৎপাদন করে। তুরস্কে ফলের দেশি বাজার এবং রপ্তানি পণ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আপেল। পুরো তুরস্কজুড়ে আপেলবাগান ছড়িয়ে আছে। তবে সবচেয়ে বেশি আপেল জন্মে মধ্য আনাতোলিয়া অঞ্চলে। অনুকূল জলবায়ু ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে তুরস্ক একদিকে যেমন দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে, অন্যদিকে আপেলের আন্তর্জাতিক বাজারে বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। তুরস্কের গ্রামীণ অর্থনীতিতে আপেল চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যের মিডলবুরিতে আপেল বাগানে ঝুলে আছে লাল রঙের আপেল

বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ আপেল উৎপাদনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে দেশটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার টন আপেল উৎপাদন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় এমন ফলের তালিকায় আপেল দুই নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে আপেলবাগান আছে। তবে অন্যদের অনেকটা পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদনকারী অঙ্গরাজ্য ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত মোট আপেলের প্রায় ৭০ শতাংশ এই অঙ্গরাজ্য থেকে আসে। নিউইয়র্ক, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া এবং ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যেও প্রচুর আপেল উৎপাদিত হয়।

পোল্যান্ড

পোল্যান্ডে একটি ফলের দোকানে বিক্রির জন্য আপেল সাজিয়ে রাখা হয়েছে

বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ আপেল উৎপাদনকারী দেশ পোল্যান্ড। ২০২২ সালে দেশটি ৪২ লাখ টনের বেশি আপেল উৎপাদন করেছে। আপেল উৎপাদনের মোট পরিমাণে দেশটি চীন, তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে হলেও মাথাপিছু হিসাবে পোল্যান্ড চীনের চেয়ে তিন গুণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ছয় গুণ বেশি আপেল উৎপাদন করে। দেশটিতে উৎপাদিত মোট ফলের ৮০ শতাংশের বেশিই আপেল।

মাটি এবং পরিবেশের কারণে পোল্যান্ডজুড়েই প্রচুর আপেলবাগান দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদন হয় দক্ষিণ–পশ্চিম, দক্ষিণ–পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলে। দেশটিতে প্রধানত ১৪ প্রজাতির আপেল জন্মে। পোল্যান্ডে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদন হয়।

ভারত

ভারতের কাশ্মীরে একটি আপেল বাগান থেকে আপেল তোলা হচ্ছে

বিশ্বের পঞ্চম আপেল উৎপাদনকারী দেশ ভারত। ভারতে মূলত জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আপেল জন্মে। এ ছাড়া অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, পাঞ্জাব এবং সিকিমে ছোট পরিসরে আপেল চাষ হয়। পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু ফল হিসেবে ভারতীয়দের কাছে আপেল দারুণ জনপ্রিয়।
এফএএস নিউ দিল্লির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ বাজার বছরে (মার্কেট ইয়ার) ভারতে ভোক্তারা ২৬ লাখ ৩০ হাজার টন আপেল কিনেছেন। ওই সময়ে দেশটিতে মোট আপেল উৎপাদন ছিল ২৪ লাখ ১০ হাজার টন। দেশীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে ভারতকে তাই আপেল আমদানি করতে হয়। ভারতে তাজা আপেলের বড় সরবরাহকারী দেশ তুরস্ক। এ ছাড়া ইরান, আফগানিস্তান, ইতালি ও পোল্যান্ড থেকে ভারত আপেল আমদানি করে।

রাশিয়া

রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়ায় একটি আপেল বাগান

ভারতের পর আপেল উৎপাদনে ষষ্ঠ অবস্থানে আছে রাশিয়া। দেশটিতে ২০২২ সালে ২৩ লাখ ৮০ হাজার টন আপেল উৎপাদন হয়েছে। রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া অঞ্চলে প্রচুর আপেল জন্মে।

ইতালি

ইতালিতে আপেল বাগান

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আপেল উৎপাদনে পোল্যান্ডের পরই আছে ইতালি। ২০২২ সালে দেশটি ২২ লাখ ৫৬ হাজার টন আপেল উৎপাদন করেছে। ইতালিতে যেসব ফসল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হয়, তার মধ্যে আপেল অন্যতম। ইতালির আপেল খুবই সুস্বাদু। দেশটিতে নানা প্রজাতির আপেল পাওয়া যায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আপেলবাগান আছে।

ইরান

ইরানে শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই গাছ থেকে আপেল তোলা হয়। ২০২২ সালে দেশটিতে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টন আপেল উৎপাদিত হয়েছে। ইরানের উরমিয়া, মাশহাদ, শেমিরান এবং আজারবাইজান প্রদেশে সবচেয়ে বেশি আপেলবাগান রয়েছে। ইরানে নানা জাতের আপেল পাওয়া যায়। দেশটি বিভিন্ন দেশে আপেল রপ্তানি করে।

ফ্রান্স

উর্বর মাটি আর অনন্য আবহাওয়ার কারণে ফ্রান্সে শতাধিক প্রজাতির আপেল জন্মে। ফ্রান্সের বাগানগুলোয় জন্ম নেওয়া আপেলের রং, গন্ধ এবং স্বাদ অতুলনীয়। ২০২০ সালে ইউরোপের দেশটিতে ১৭ লাখ ৮৬ হাজার টন আপেল উৎপাদিত হয়েছিল। কিন্তু এরপর ফ্রান্সে আপেল উৎপাদন খানিকটা পড়তির দিকে। জলবায়ুসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের কারণে ফ্রান্সে আপেল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

চিলি

চিলির মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদিত হয়। দেশটিতে জানুয়ারির শেষ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আপেলের মৌসুম। চিলি ৪০ ধরনের বেশি আপেল রপ্তানি করে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় রয়্যাল গালা, রিচার্ড ডিলিসিয়াস, গ্রানি স্মিথ ও গালা। ২০২২ সালে চিলিতে ১৪ লাখ ৮০ হাজার টন আপেল উৎপাদিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ