
উদ্যোগী কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লক্ষ্য ২০২৪–এর লোকসভা ভোটের আগেই বিজেপিবিরোধী বৃহত্তর জোট গঠন। সেই লক্ষ্যে শামিল হলেন দেশের ১৯টি বিরোধী দলের নেতা–নেত্রীরা। তাঁদের সংকল্প, নিজস্ব বাধ্যবাধকতা ভুলে দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলা।
বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দেশের স্বার্থে ১৯ দলের পক্ষে বিভিন্ন রাজ্যে ২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
গত শুক্রবার সোনিয়া গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জোটবদ্ধতার এ সলতে পাকানোর প্রচেষ্টায় যে বিষয়টি অনুচ্চারিত ও অমীমাংসিত রয়ে গেল, শাসক বিজেপির অবিসংবাদিত নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তুরুপের তাস সেটাই। বিরোধী জোটের নেতৃত্ব কে দেবেন? বস্তুত কংগ্রেসের হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে দিতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি যাঁর, সংসদীয় অধিবেশন চলাকালীন বিভিন্নভাবে যা তাঁর দলের নেতারা বুঝিয়েও দিয়েছেন, সেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবারের ভার্চ্যুয়াল বৈঠকেও তা স্পষ্ট করে দেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন, কোনো বিশেষ দলকে প্রাধান্য না দিয়ে জোটের কর্মসূচি ঠিক করতে একটা ‘কোর কমিটি’ তৈরি করা হোক। কমিটিই ঠিক করবে কোন কোন বিষয়ে কোথায় কীভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
মমতার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন সোনিয়া গান্ধী। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ও ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের সঙ্গে সহমত হয়েছেন প্রবীণ মারাঠা রাজনীতিক শারদ পাওয়ারও। জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মতৈক্য সত্ত্বেও বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে একাধিক প্রশ্নে নেতাদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দেয়। ঠিক হয়েছে, কোর কমিটি গঠিত হলে প্রতি মাসে তারা একবার করে বৈঠক করবে। নেতারাও পারস্পরিক আলোচনা অব্যাহত রাখবেন।
এর আগে ২৮ জুলাই মমতার সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেন সোনিয়া ও রাহুল। এর দিন কয়েকের মধ্যেই সোনিয়া ২০ আগস্টের বৈঠকের কথা ঘোষণা করেন। তার মধ্যে সংসদীয় অধিবেশন চলাকালীন রাহুল গান্ধীর উদ্যোগে একাধিকবার বিভিন্ন দলের নেতারাও বৈঠক করেন। সেই সব বৈঠকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস যোগ দিলেও কয়েকটিতে গরহাজির ছিল। প্রকাশ্যে এ কথাও তৃণমূল নেতারা জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে ডাকলেই তাঁরা চলে যাবেন, তা যেন কেউ মনে না করে। বস্তুত রাহুলকে কেন্দ্র করে বিরোধী জোট দানা বাঁধুক, তৃণমূল কংগ্রেস তা চায় না। বরং তারা চায় জোটের নেতৃত্ব দিন মমতাই। শুক্রবারের ভার্চ্যুয়াল বৈঠকেও তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে মমতা ‘কোর কমিটি’ গড়ার প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, ‘ভুলে যান কে নেতা। ব্যক্তিগত চাহিদা সরিয়ে রাখুন। আমরা কেউ নেতা নই। জনতাই নেতা বেছে দেবে। লক্ষ্য স্থির রেখে জনগণের স্বার্থে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এই লড়াইয়ে ইগোর কোনো স্থান নেই।’
জোটের কর্মসূচি ঠিক করতে একটি ‘কোর কমিটি’ তৈরির সিদ্ধান্ত।কমিটিই ঠিক করবে কোন কোন বিষয়ে কোথায় কীভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।কোর কমিটি গঠিত হলে প্রতি মাসে তারা একবার করে বৈঠক করবে।
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা সভার শুরুতেই সোনিয়া শুনিয়ে দেন। সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেন, প্রত্যেককে নিজস্ব বাধ্যবাধকতা সরিয়ে এগোতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেগুলো অস্বীকার করাও যায় না। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দেশের স্বার্থ। দেশ, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী ধ্যানধারণার স্বার্থে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে এখন একজোট হতে হবে।’
কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, চার বামপন্থী দল, এনসিপি, ডিএমকে, আরজেডি, ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপিসহ ১৯টি দলের নেতারা অংশ নিলেও গরহাজির ছিলেন আম আদমি পার্টি, অকালি দল, এসপি, বিএসপি, বিজেডি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস ও টিআরএসের মতো দলের নেতারা। আম আদমি পার্টি ও অকালি দল পাঞ্জাবে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী। এসপি উত্তর প্রদেশের ভোটে একা লড়ার কথা জানিয়েছে।
বিএসপির সঙ্গে বিজেপির ‘সমঝোতা’ রয়েছে বলে রাজনৈতিক প্রচার। বিজেডি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস ও টিআরএস গত সাত বছরে নানাভাবে বিজেপি সরকারকে সংসদে উতরে দিয়েছে। রাজ্য চালানোর স্বার্থে তারা বিজেপির বিরুদ্ধে সংঘাতে যেতে রাজি নয়। এসপি নেতা অখিলেশ যাদব একটি বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, লক্ষ্ণৌর বাইরে সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় বৈঠকে যোগ দিতে পারছেন না। এ দলগুলোকে বৃহত্তর জোটে কেন শামিল করা হবে না, সেই প্রশ্ন বৈঠকে ওঠে। মমতা বলেন, সবাইকে ডাকতে হবে।
বিহার ভোটে ভালো ফল করা সিপিআই (এমএল) লিবারেশন নেতা দীপংকর ভট্টাচার্যকে কেন ডাকা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে মমতা বলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হলে কাউকে বাইরে রাখা উচিত নয়। তিনি বলেন, যে দলগুলো কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত নয় অথচ বিজেপির বিরুদ্ধে তাদেরও ডাকা দরকার। এ প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, গণতন্ত্র ও সংবিধান ধ্বংস করে বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগোচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোন দল কোন দিকে থাকবে, তা তাদেরই ঠিক করতে হবে।
বৈঠকের আলোচ্যসূচি সম্পর্কিত একটা খসড়া প্রস্তাব নেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল তাতে সম্মতিসূচক সই দিতে। মমতা সই করেননি। তাঁর বক্তব্য, বৈঠকের পর সম্মিলিত প্রস্তাব দেখে তিনি সম্মতি দেবেন। ঠিক হয়েছে, সবার জন্য বিনা মূল্যে কোভিডের টিকা, পেট্রল–ডিজেলের মূল্য হ্রাস, কৃষি আইন প্রত্যাহার, বিনা বিচারে ধৃতদের মুক্তি, পেগাসাসের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মতো কয়েকটি দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করা হোক। মানুষের দুর্দশা কমাতে ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে আয়করের আওতার বাইরে থাকা পরিবারের হাতে মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়। সিপিআইয়ের ডি রাজা বলেন, আরএসএস তার খোলস ছড়াচ্ছে। রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করছে। এ প্রবণতা রোখার দায়িত্ব মানুষের। আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব বলেন, বিজেপি যে অজেয় নয়, তা বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ দেখিয়ে দিয়েছে।
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা বিরোধীদের সক্রিয় করে তুললেও সব বিরোধী দলের জোটবদ্ধ না হওয়া ও নেতৃত্বের প্রশ্ন অনুচ্চারিত থাকা আপাতত নরেন্দ্র মোদির শ্লাঘার কারণ হয়েই থাকছে।