Thank you for trying Sticky AMP!!

বিজেপির বাড়বাড়ন্তে শঙ্কিত মমতা, খেলছেন নতুন ছকে

(বাঁ থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ, আবদুল মান্নান ও সুজন চক্রবর্তী

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বাড়বাড়ন্তে এবার শঙ্কিত হয়ে পড়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এত দিনে বিজেপির উত্থানের বিষয়টি মমতার মনে ততটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই রাজ্য থেকে তাঁরা কংগ্রেস ও সিপিএমকে হটাতে পেরেছেন; বিজেপি তো কোনো ঘটনা নয়। তাই সামনে আর তাঁদের কোনো বিপদ নেই। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের দল হেসেখেলে জিতে যাবে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে বিজেপি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তাতে মমতার ঘুম হাওয়া। এখন দিন দিন বাড়ছে মোদির সমর্থকদের সংখ্যা। কমছে কংগ্রেস, সিপিএম সেই সঙ্গে তৃণমূলও। সেই ছবিই স্পষ্ট হয়ে গেছে গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বিজেপি রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি জিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছে রাজ্যবাসীকে। মমতার দল জিতেছে ২২টি আসনে। আর বাম দল পায়নি কোনো আসন। কংগ্রেস জিতেছে দুটি আসনে। এই ৪২ আসনের মধ্যেই রয়েছে রাজ্য বিধানসভার ২৯৪টি আসন। এর মধ্যে ১২১টি আসনে শীর্ষে থেকে বিজেপি চমক দিয়েছে। আর এসব ফলাফলের পর বিজেপি বুঝেছে যে সামনে আসছে তাদের সুদিন। আগামী বছরের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জেতার আশা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি। আর এসব ঘটনায় শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে মমতার দলে। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ০১ শতাংশ মুসলিম ভোট। আর হিন্দু ভোটের সংখ্যা ৭০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। মুর্শিদাবাদ, মালদহ আর উত্তর দিনাজপুরে মুসলিম ভোটের সংখ্যাধিক্য। যদিও ভারতে মুসলিম জনসংখ্যায় দ্বিতীয় রাজ্য হলো এই পশ্চিমবঙ্গ। এখানে ২ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মুসলিম। প্রথম অবশ্য উত্তর প্রদেশ—সেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮৪ লাখের বেশি। তৃতীয় স্থানে বিহার (১ কোটি ৭৫ লাখের বেশি), আর চতুর্থ স্থানে মহারাষ্ট্র (১ কোটি ২৯ লাখের বেশি)।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় মুসলিম ভোট পেতে বরাবরই এগিয়ে ছিল কংগ্রেস ও বাম দল। এরপর আসে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এখনো বেশির ভাগ সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে আছে। আর সামান্য কিছু বাম দল ও কংগ্রেসের দিকে। মমতা তাই এই রাজ্যে রাজনীতিও করেন সংখ্যালঘু ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু সেই ভোটব্যাংকে এবার থাবা বসাতে চলেছে বিজেপি। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সেই চিত্র ধরাও পড়ে। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনের পর তাই পাল্টে যায় এই রাজ্যের ভোটের চিত্র। বহু মধ্যপন্থী হিন্দু মমতার সঙ্গ ছাড়েন। মমতাও বুঝতে পারেন হিন্দুদের একাংশের ভোট হাতছাড়া হচ্ছে তাঁদের। তাই নতুন ছক নিয়ে মমতা মাঠে নেমেছেন। হিন্দু ভোটে এবার তাঁদের অবস্থান সুসংহত করতে হবে। সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট তো তাঁদের রয়েছেই।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এবার মমতা হিন্দু ভোট পেতে নতুন ছকে খেলছেন। গত সপ্তাহে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, রাজ্যের আট হাজার ব্রাহ্মণ ও পুরোহিত মাসে এক হাজার রুপি করে ভাতা পাবেন। এর লক্ষ্য বিজেপির হাত থেকে হিন্দু ভোট নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা।

মমতা ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য প্রথম এই রাজ্যে ভাতা চালু করেছিল। আর সেটা চালু করা হয়েছিল রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে। ওই সময় পুরোহিতেরা দাবি তুলেছিল তাঁদেরও ভাতা দেওয়ার। কিন্তু মমতা সেদিন সাড়া দেননি। এবার সাড়া দিলেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর মমতা রাজ্য সচিবালয় নবান্নে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা দেন, এই রাজ্যের আট হাজার ব্রাহ্মণ ও গরিব পুরোহিতকে মাসে এক হাজার রুপি করে ভাতা দেওয়া হবে। আবার যেসব গরিব পুরোহিতের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাঁদেরও গড়ে দেওয়া হবে বাড়ি। এ ছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটে সনাতন ব্রাহ্মণ ট্রাস্টের মাধ্যমে তৈরি করা হবে হিন্দু তীর্থস্থান ও মন্দির। এই লক্ষ্যে মমতা তাঁদের জমিও দিয়েছেন। পুরোহিতদের ভাতা দেওয়া হবে আগামী মাস থেকেই।

পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ব্রাহ্মণ ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক শ্রীধর মিশ্র মমতার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, রাজ্যের ৩৫টি পুরোহিত সংগঠনকে এক ছাতার তলে এনে গড়া হয়েছে এই সনাতন হিন্দু ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের সদস্যসংখ্যা এখন ২ লাখ ৭৩ হাজার। ভবিষ্যতে বাড়তে পারে ভাতাপ্রাপ্ত পুরোহিতদের সংখ্যাও। এখন অবশ্য রাজ্যে রয়েছে ৫৯ হাজার ইমাম ও মুয়াজ্জিন। ইমামদের ভাতা দেওয়া হয় মাসে ২ হাজার ৫০০ আর মুয়াজ্জিনদের দেওয়া হয় ১ হাজার রুপি করে।

যদিও অন্যদিকে ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রাজ্য বিজেপিও। আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে রাজ্যের বিধানসভার ২৯৪টি আসনে নির্বাচন হওয়ার কথা। এর মধ্যে ৪১টি মুসলিম–অধ্যুষিত আসন। এ ছাড়াও রাজ্যের ১০০টি আসনে মুসলিম ভোট একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। তাই মুসলিম ভোট কবজা করার জন্য এবার বিজেপি মাঠে নামিয়েছে দলটির মুসলিম নেতাদের।

পুরোহিতদের ভাতা ঘোষণার পর রাজ্য বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেস বিধায়ক আবদুল মান্নান বলেছেন, ‘এরপর খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ভাতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকারের কাজ মন্দির-মসজিদ গড়া বা ইমাম–পুরোহিতদের ভাতা দেওয়া নয়। বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে, তৃণমূলও সেই তাস খেলছে।’

সিপিএমের পরিষদীয় দলের নেতা বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘আগে ইমাম ভাতা ঘোষিত হয়েছিল, এবার ভোটের সময় এসে যাওয়ায় পুরোহিতদের ভাতা দিয়ে মন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ধর্মের সঙ্গে আর্থিক সাহায্যের বিষয়টিকে জুড়ে দিয়ে বিজেপির রাজনীতিকেই মদদ দেওয়া হচ্ছে।’

আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘মমতার এত দিন পর মনে পড়ল পুরোহিতদের কথা। সামনে ভোট, তাই পুরোহিতদের মন পেতে উৎকোচ দিচ্ছেন। বাংলার মানুষ বোকা নন, বাংলার মানুষ মমতার ভোটের রাজনীতি ধরে ফেলেছেন।’