অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ
অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ

পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পর শিক্ষাবিদ, শিল্পীদের নানাভাবে হয়রানি করছে বিজেপি সরকার

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ১০ মে কিছুটা কমার পরে ভারতের ভেতরে দেশবিরোধী কথা বলার অভিযোগে একাধিক শিক্ষাবিদ বা সাংস্কৃতিক কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। এতে আতঙ্কিত হচ্ছে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু প্রশ্ন তোলায় গত রোববার আলী খান মাহমুদাবাদ নামের একজন শিক্ষাবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাশ্মীরি পণ্ডিত অধ্যাপক নিতাশা কলের ওসিআই (ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অব ইন্ডিয়া) কার্ড বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ফলে নিতাশা ভারতে এসে আর অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে পারবেন না বা বারবার এ দেশে আসতে পারবেন না।

সরকারের এমন পদক্ষেপের ফলে নিতাশার গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, তাঁর মূল কাজ কাশ্মীরের মানবাধিকার এবং সেখানে নানাভাবে বিপর্যস্ত নারীদের নিয়ে। একই সঙ্গে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করা হয়েছে। কারণ, তাঁরা এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী উপমহাদেশের বিশিষ্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের একটি গান গেয়েছিলেন। যে গানটি তাঁরা গেয়েছিলেন, সেটি হলো ‘হাম দেখেঙ্গে, লাজিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে’। অর্থাৎ ‘আমরাও দেখব, কাজটা সঠিক হচ্ছে কি না।’

১৯৭৯ সালে বামপন্থী কবি ফয়েজের লেখা এই গান ভারত ও পাকিস্তানে বিভিন্ন শিল্পী এবং গণসংগঠন বারবার গেয়েছে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

যে কারণ দেখিয়ে অধ্যাপক নিতাশার ওসিআই কার্ড বাতিল করা হয়েছে, সেটি হলো তিনি ‘বিদ্বেষে অনুপ্রাণিত এবং তথ্য বা ইতিহাসের প্রতি অবহেলা করে ভারতবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ও সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে আপনার বিদ্বেষমূলক লেখা, বক্তৃতা এবং সাংবাদিকতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আপনি ভারতের সার্বভৌমত্বকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করেছেন।’

সামাজিক মাধ্যমে অধ্যাপক নিতাশা তাঁর ওসিআই বাতিলের খবর জানিয়ে লিখেছেন, ‘এটি একটি খারাপ বিশ্বাস, যা প্রতিশোধমূলক। এটি আন্তর্জাতিক দমন-পীড়নের এক নিষ্ঠুর উদাহরণ। অগণতান্ত্রিক ও সংখ্যালঘুবিরোধী কর্মকাণ্ডের গবেষণামূলক কাজের জন্য আমায় শাস্তি দিল মোদির শাসনব্যবস্থা।’

২০১৯ সালের আগস্টে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার পর ওই বছরের অক্টোবরে নিতাশা জম্মু-কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে পররাষ্ট্রবিষয়ক মার্কিন হাউস কমিটির শুনানির অন্যতম প্রধান সাক্ষী হিসেবে কাজ করেছিলেন।

অধ্যাপক নিতাশার কাজের প্রধান ক্ষেত্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ও ঔপনিবেশিক–উত্তর নতুন অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও তার সঙ্গে যুক্ত জাতীয়তাবাদ, ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প, কাশ্মীরের অতীত, মৌখিক ইতিহাস, সার্বিক ইতিহাস এবং কাশ্মীরের নারীদের অবস্থা ও অবস্থান। তাঁর কাজ নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে অধ্যাপক নিতাশার বিরোধ অতীতে হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির নেতারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠিও লিখেছেন।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক নিতাশা বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাঁকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার তাঁকে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএএস) ধর্মীয় শাখা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) কর্ণাটকের এক নেতা গিরিশ ভরদ্বাজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে নিতাশার ওসিআই কার্ড বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। অধ্যাপক নিতাশাকে আমন্ত্রণ জানানোয় তিনি কংগ্রেস সরকারের কঠোর নিন্দা করেন।

কাশ্মীরি পণ্ডিত অধ্যাপক নিতাশা কল

ফয়েজের গান গাওয়ায় দেশদ্রোহের মামলা

গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে একদল তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মী পাকিস্তানের কবি ফয়েজের বিখ্যাত কবিতা ও গান ‘হাম দেখেঙ্গে’ গেয়েছিলেন বলে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে অভিনেতা ও কর্মী ভিরা সাথিদার স্মরণে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একদল তরুণ সংস্কৃতি কর্মী ফয়েজের বিখ্যাত ‘হাম দেখেঙ্গে’ গান গেয়েছিলেন।

নাগপুর পুলিশ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) ১৫২ ধারার অধীনে আয়োজক এবং বক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিএনএসের অন্যান্য ধারাসহ, ১৯৬ (গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা লক্ষ্যে কাজ করা) এবং ৩৫৩ (প্রকাশ্য নৈরাজ্য উদ্রেগ) ধারাসহ রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে সম্পর্কিত ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। অভিযোগে স্পষ্টভাবে ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ না করে আয়োজক এবং বক্তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভিরা সাথিদার নামে মহারাষ্ট্র ও ভারতের একজন দক্ষ অভিনেতা, বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদের স্মরণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি ২০২১ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁর স্ত্রী পুষ্পা এই বার্ষিক স্মরণসভার আয়োজন করেন।

এবারে সমাজকর্মী উত্তম জায়গিরদারকে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিদর্ভ সাহিত্য সংঘের আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেড় শ জনের বেশি লোকের উপস্থিতিতে জায়গিরদার বিতর্কিত মহারাষ্ট্র বিশেষ পাবলিক সিকিউরিটি বিল–২০২৪ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য রেখেছিলেন।

বিজেপি-নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র সরকার এই বিলকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা করছে। সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদেরা বিশ্বাস করেন, এই বিল আইনে পরিণত হলে মানবাধিকার হরণের ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত হবে। যেকোনো ভিন্নমতের বক্তব্যকেই ‘আরবান নকশাল’ বা শহুরে নকশাল হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।