উত্তর প্রদেশের কানপুরে ভোটের পর কালিমাখা আঙুল দেখাচ্ছেন ভোটাররা। ১৩ মে
উত্তর প্রদেশের কানপুরে ভোটের পর কালিমাখা আঙুল দেখাচ্ছেন ভোটাররা। ১৩ মে

বিজেপির আসন বাড়বে কি না, সেই পরীক্ষা হয়ে গেল চতুর্থ দফায়

চতুর্থ দফার ভোটের গতিপ্রকৃতি বুঝিয়ে দেবে পরপর তিনবার ক্ষমতাসীন থাকার ক্ষেত্রে বিজেপি কতটা নিশ্চিত হতে পারছে। আজ সোমবার দেশের ১০ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে লোকসভার ৯৬ আসনে ভোট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ছাড়া কোথাও নির্বাচনী সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। অন্যান্য বারের তুলনায় এই দফায় ভোটের হার আশাব্যঞ্জক। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে অনুযায়ী বেলা তিনটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে গড়ে ৫২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আজ অন্ধ্র প্রদেশের সব লোকসভা আসনের সঙ্গে ভোট হলো রাজ্য বিধানসভারও।

এই দফার ভোট বিজেপির জন্য বড় এক পরীক্ষা। মোট ৯৬ আসনের মধ্যে বর্তমানে কেবল তাদের দখলেই রয়েছে ৪২টি। তাদের জোটসঙ্গীদের রয়েছে আরও সাতটি আসন। অর্থাৎ ৯৬টির মধ্যে ৪৯টিই এনডিএর দখলে।

বিজেপির আশার উৎস প্রধানত অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা। এই দুই রাজ্যের ৪২ আসনের ভোট আজ সোমবার হয়ে গেল। সেই সঙ্গে হলো অন্ধ্র প্রদেশের ১৭৫ বিধানসভা আসনেরও ভোট। লোকসভার গত দুটি ভোটে অন্ধ্র প্রদেশে বিজেপি একটি আসনেও জিততে পারেনি। তেলেঙ্গানায় পেয়েছিল ৪টি আসন। বিজেপির আশা, এবার দুই রাজ্য মিলিয়ে তারা জোট শরিকদের সঙ্গে নিয়ে ২২ থেকে ২৫টি আসন আদায় করে নেবে। তা হলে তারা তৃতীয়বার ক্ষমতা ধরে রাখার পথে এগিয়ে যাবে অনেকটাই।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নিয়েও আশাবাদী বিজেপি। উত্তরবঙ্গের ঘাঁটি ছেড়ে ভোট এসেছে দক্ষিণবঙ্গে। এই দফায় ৮ আসনে ভোটের গতিপ্রকৃতি বুঝিয়ে দেবে, গতবার পাওয়া ১৮ আসন তারা এবার ধরে রাখতে পারবে কি না। ৮ আসনের নিরাপত্তা রক্ষায় নির্বাচন কমিশন তৎপর। প্রায় চার হাজার বুথ তাদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর।

অন্ধ্র প্রদেশে বিজেপির জোটসঙ্গী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর দল তেলুগু দেশম (টিডিপি) ও তেলুগু সুপারস্টার পবন কল্যাণের জন সেনা পার্টি (জেএসপি)। জোটবদ্ধ বিজেপি লড়ছে ছয়টি লোকসভা আসনে। প্রধান প্রতিপক্ষ শাসক ওয়াইএসআর কংগ্রেস। এই রাজ্যে কংগ্রেস সবচেয়ে দুর্বল। গতবারের ভোটে তাদের ভোটের হার ২ শতাংশে এসে ঠেকেছিল। এবার কংগ্রেসের ভরসা মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহনের ছোট বোন শর্মিলা। তাঁর দৌলতে কংগ্রেসের ভোটের হার বাড়লেও আসন পাওয়া কঠিন।

এই ভোটের পর অন্ধ্র প্রদেশের রাজনীতি কোন দিকে বাঁক নেয়, তা অবশ্যই দেখার। রাজ্য রাজনীতিতে চন্দ্রবাবু ও জগন্মোহনের সম্পর্ক সাপে–নেউলে। এত দিন ধরে যেকোনো কারণেই হোক (ইডি–সিবিআইয়ের ভয়ও হতে পারে) বিভিন্ন বিল পাসের ক্ষেত্রে জগন্মোহনের দল এনডিএ সরকারকে সংসদে সমর্থন দিয়ে এসেছে। বিজেপি–টিডিপি জোট হওয়ায় ভোটের পর তিনি কী করবেন, একটা প্রশ্ন।

অন্যদিকে বিজেপির হাত ধরলেও ভোটের পর কেন্দ্রে সরকার গঠন অনিশ্চিত হলে চন্দ্রবাবু নাইডু কী করবেন, সেই জল্পনাও শুরু হয়েছে। কারণ, নাইডু বিজেপির ঘর যেমন করেছেন, তেমন বেরিয়েও এসেছেন। তা ছাড়া বিজেপির সঙ্গে তাঁর দলের মতবিরোধও এবার প্রকাশ্যে এসেছে। বিজেপি যেখানে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের তীব্র বিরোধিতা করছে, চন্দ্রবাবু সেখানে বারবার বলে আসছেন, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে মুসলমানদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করবেন।

অবশ্য এটাও ঠিক, ইডি–সিবিআইয়ের ভয় চন্দ্রবাবুরও আছে। টিডিপি–বিজেপি–জেএসপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে মুসলমান সংরক্ষণের প্রশ্নে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে কি না, তা–ও দেখার বিষয়।

এই পর্বেও বিরোধীদের আশার আলো দেখাচ্ছে মহারাষ্ট্র (১১), বিহার (৫), ঝাড়খন্ড (৪) এবং কিছুটা উত্তর প্রদেশ (১৩)। মহারাষ্ট্রের ১১ আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি জিতেছিল ৯টি ও বিহারের ৫ আসনের প্রতিটি। ঝাড়খন্ডের ৪ আসনের তিনটিও তারা পেয়েছিল। এ ছাড়া উত্তর প্রদেশের ১৩ আসনের সব কটি। ‘ইন্ডিয়া’ জোট মনে করছে, প্রথম তিন পর্বের ট্রেন্ড অব্যাহত থাকলে চতুর্থ পর্বের মোট ৯৬ আসনের মধ্যে পাওয়া ১১টি আসন এবার বাড়বে। তাদের বিশ্বাস, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খন্ড ও উত্তর প্রদেশে বিজেপি বড় ধাক্কা খাবে।

উত্তর প্রদেশে এবারের পরিস্থিতি গতবারের তুলনায় ভিন্ন বলে মনে করছে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও কংগ্রেস। জোট নেতাদের দাবি, প্রথম তিন দফায় রাজ্যের মুসলমান, জাট ও কৃষক সমাজ যেভাবে একজোটে বিজেপির বিরোধিতা করেছে, তাতে শাসক দলের অনেক জেতা আসন তারা এবার ছিনিয়ে নেবে। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ডে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রতি সহানুভূতির হাওয়া বইছে বলে বিরোধীদের দাবি। মহারাষ্ট্রের জনতা সহানুভূতিশীল উদ্ধব ঠাকরে ও শারদ পাওয়ারের প্রতি।

ঝাড়খন্ডের মানুষের সহানুভূতি জেলবন্দি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের প্রতি। তাঁর স্ত্রী কল্পনা সোরেন প্রচারের মুখ্য আকর্ষণ। বিহারে সহানুভূতি নেই, তবে জাত সমীকরণ আছে। আর রয়েছে জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমারের প্রতি বিরক্তি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মহারাষ্ট্র ও বিহারে বিজেপির জোটসঙ্গীদের যতটা ক্ষতি হবে, তা মেটানোর মতো অবস্থা এবার বিজেপির থাকবে না।

রাজ্য দুই ভাগ করার পর কাশ্মীর উপত্যকার শ্রীনগর আসনে এটাই প্রথম ভোট। তেমন উদ্দীপনা না থাকলেও উৎসাহে ঘাটতি ছিল না। এই আসনে ২০১৯ সালে ভোট পড়েছিল ১৫ শতাংশেরও কম। আজ সোমবার ভোটের সেই হার বেলা ১১টাতেই টপকে গেছে। এই আসনে এবার ন্যাশনাল কনফারেন্সের (এনসি) ওমর আবদুল্লা প্রার্থী হননি। প্রার্থী হয়েছেন আগা রহুল্লাহ। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পিডিপির ওয়াহিদ উর রহমান পারা ও বিজেপি সমর্থিত আপনি পার্টির মহম্মদ আশরাফ মীর। আশরাফ মীরকে সমর্থন করছে সাজ্জাদ লোনের পিপলস কনফারেন্সও।

নব্বইয়ের দশকে অশান্ত হওয়ার পর এই প্রথম কাশ্মীর উপত্যকার কোথাও ভোট বর্জনের ডাক শোনা গেল না। উপত্যকার বাকি দুই আসন বারামুলা ও অনন্তনাগ–রাজৌরি কেন্দ্রের ভোট পরের দুই দফায়। উপত্যকার তিন আসনের একটিতেও বিজেপি প্রার্থী দেয়নি।

উত্তর প্রদেশের কনৌজে নির্ধারিত হয়ে গেল ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এসপি নেতা অখিলেশ যাদবের ভাগ্য। এই রাজ্যের লখিমপুর খেরিতে বিজেপির প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র। তাঁর ছেলে আশিস আন্দোলনকারী কৃষকদের ওপর গাড়ি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের ভাগ্য নির্ধারিত হলো বিহারের বেগুসরাই আসনে। অন্ধ্র প্রদেশে কংগ্রেস নেত্রী ওয়াই এস শর্মিলা কাডাপ্পা আসনে জিতলে বোঝা যাবে, বড় ভাই মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহনকে কতটা চ্যালেঞ্জ তিনি আগামী দিনে দিতে পারবেন।

হায়দরাবাদে এআইএমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়েইসির লড়াই বিজেপি নেত্রী মাধবী লতার সঙ্গে। সেকেন্দরাবাদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিষেন রেড্ডির চ্যালেঞ্জার কংগ্রেস ও বিআরএস। ত্রিমুখী লড়াইয়ে কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে সেটাই দেখার। ঝাড়খন্ডের খুন্তিতে নির্ধারিত হলো বিজেপির অর্জুন মুন্ডার ভাগ্য। গতবার ওই আসন তিনি জিতেছিলেন মাত্র দেড় হাজার ভোটে। তাঁকে টক্কর দিচ্ছেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কংগ্রেস প্রার্থী কালিচরণ মুন্ডা।

মহারাষ্ট্রের বিড় কেন্দ্রে বিজেপির পঙ্কজা মুন্ডে হেরে গেলে ধরে নিতে হবে, ওই রাজ্য বিজেপির মাথাব্যথার কারণ হতে চলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের ৮ আসনের মধ্যে নজর বেশি বহরমপুরে। কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী জানিয়েছেন, হেরে গেলে রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন। সেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। কৃষ্ণনগরে মহুয়া মৈত্র জিতলে সেটা হবে লোকসভা থেকে তাঁকে তাড়ানোর মোক্ষম জবাব। বিজেপির সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে (বর্ধমান–দুর্গাপুর) মোকাবিলা করতে হলো তৃণমূল কংগ্রেসের কীর্তি আজাদের। তৃণমূল কংগ্রেসের শত্রুঘ্ন সিনহার গুরু দায়িত্ব আসানসোল ধরে রাখা।