সবচেয়ে বেশি বাঘের বিচরণ ভারতে, বাংলাদেশে কত

বাঘকে বলা হয় বনের রাজা। দেখতে যেমন, তেমনই প্রাণীটির চলাচল, ভঙ্গি বা চাহনিও বেশ রাজকীয়। কিন্তু মাংসাশী এই প্রাণীর সংখ্যা বিশ্বজুড়ে কমছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বন উজাড়, বাঘ শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের কারণে এক শতাব্দীর ব্যবধানে বন্য বাঘের সংখ্যা বিপর্যয়করভাবে কমেছে।

তবে আশার আলো একেবারে নিভে যায়নি। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কয়েকটি দেশ ব্যাপকভাবে বাঘ সংরক্ষণে মনোযোগ দিচ্ছে। গ্লোবাল টাইগার ফোরামের (জিটিএফ) ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বন্য বাঘের মোট সংখ্যা এখন প্রায় ৫ হাজার ৫৭৪। এর বেশির ভাগই বাস করে এশিয়ার ১০টি দেশে।

নিচে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাঘ থাকা ১০টি দেশের তালিকা তুলে ধরা হলো। এতে শুধু পরিসংখ্যান নয়, অল্প পরিসরে বাঘ সংরক্ষণের গল্প, বনভূমির বৈচিত্র্য এবং স্থানীয় মানুষ ও বাঘের সম্পর্ক নিয়ে তুলে ধরা হলো।

ভারত

ভারতের বাঘের সংখ্যা বেড়েছে

বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বাঘ আছে ভারতে। দেশটিতে বর্তমানে অন্তত ৩ হাজার ১৬৭টি বাঘ রয়েছে, যা বিশ্বের মোট বন্য বাঘের প্রায় ৫৭ শতাংশ। এসব বাঘ দেশটির ২০টি রাজ্যের ৫৮টি সংরক্ষিত অভয়ারণ্যে বিচরণ করে। ১৯৭৩ সালে চালু করা জাতীয় কর্মসূচি ‘প্রজেক্ট টাইগার’-এর কারণে দেশটিতে বাঘ বেড়েছে।

ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে উত্তরাখন্ডের করবেট টাইগার রিজার্ভে এককভাবে সর্বোচ্চ ২৬০টি বাঘ রয়েছে। পাশেই রাজাজি টাইগার রিজার্ভেও বাঘের দেখা মেলে। মধ্য ভারতের কানহা-বান্ধবগড়, পশ্চিমঘাট-সাহ্যাদ্রি, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ও আসামের মানাস অভয়ারণ্যেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঘের বিচরণ রয়েছে। ভারতের সাফল্য বিশ্বে বাঘ সংরক্ষণের আদর্শ।

রাশিয়া

রাশিয়ায় বিরল প্রজাতির সাইবেরিয়ান টাইগারের দেখা মেলে।

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। এখানে বিরল প্রজাতির সাইবেরিয়ান টাইগারের দেখা মেলে, যাদের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৫০। ঠান্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার মতো শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও ঘন লোমের কারণে এই প্রজাতির বাঘ বিশেষভাবে পরিচিত। সাইবেরিয়ার সিখোত-আলিন পর্বতশ্রেণি ও আমুর-হেইলং বনাঞ্চলেই অধিকাংশ বাঘ বাস করে।

সোভিয়েত আমলে একসময় বাঘের সংখ্যা এক শর নিচে নেমে এসেছিল। কঠোর শিকারবিরোধী আইন ও বিশেষ সংরক্ষণের কারণে ধীরে ধীরে দেশটিতে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। রাশিয়ায় ঠান্ডা বনাঞ্চলে বাঘের টিকে থাকার সংগ্রাম অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক আলাদা।

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ায় টিকে আছে কেবল এক প্রজাতির বাঘ

তৃতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ায় টিকে আছে কেবল একটি প্রজাতির বাঘ, যা মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত। এর নাম ‘সুমাত্রান টাইগার’। একসময় জাভা ও বালিতে আরও দুই প্রজাতির বাঘ ছিল, কিন্তু তারা এখন বিলুপ্ত। সুমাত্রায় এখন প্রায় ৪০০ বাঘ রয়েছে।

সুমাত্রার গুনুং লেউসার, কেরিনচি-সেবলাত ও বুকিত বারিসান সেলাতান জাতীয় উদ্যান বাঘের অভয়ারণ্য। কিন্তু বনভূমি ধ্বংস ও পাম অয়েল চাষের কারণে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

নেপাল

নেপালে ১২ বছরে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে

নেপালই বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এখন দেশটিতে ৩৫৫টি বাঘ রয়েছে। মূলত চিতওয়ান, বারদিয়া ও পারসা জাতীয় উদ্যানে তাদের বসবাস। ‘কমিউনিটি কনজারভেশন’-এর মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় সাফল্যের দেখা পেয়েছে দেশটি। ‘হিমালয়কন্যা’ হিসেবে পরিচিত দেশটিতে বাঘ শুধু বন্য প্রাণী নয়, জাতীয় গর্বের প্রতীক।

থাইল্যান্ড

থাইল্যান্ডে এখন ১৮৯টি বাঘ আছে। তাদের বেশির ভাগই ইন্দোচায়নিজ টাইগার, যারা একসময় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় বনাঞ্চল, বিশেষ করে হুয়াই খা খাং, মে ওয়াং ও খাও ইয়াই-ডং ফায়া ইয়েন অঞ্চলে এসব বাঘের দেখা মেলে। গত এক দশকে সংরক্ষণের ফলে দেশটিতে সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। তবে দেশটির বাঘের বিপদের শঙ্কা এখনো কাটেনি।

ভুটান

ভুটানে রয়েছে ১৫১টি বাঘ। তাদের মূলত রয়্যাল মানাস ও জিগমে দর্জি জাতীয় উদ্যানে দেখা যায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এসব বাঘ ৪ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায়ও বিচরণ করতে সক্ষম। ভুটানে বাঘ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও বন রক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মালয়েশিয়া

ভুটানের চেয়ে মাত্র একটি কম বাঘ নিয়ে সপ্তম স্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া। মালায়ান টাইগার নামে পরিচিত এই প্রজাতির বাঘ এখন মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত। বনভূমি ধ্বংস ও শিকারের কারণে তাদের বিলুপ্তির ঝুঁকি এখনো প্রবল। দেশটির অধিকাংশ বাঘের বিচরণ টেমান নেগারা, বেলুম-তেমেনগর ও সীমান্তবর্তী বনাঞ্চলে।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশে সুন্দরবনে বাঘ বিচরণ করে

বাংলাদেশে বর্তমানে বাঘ রয়েছে ১৪৬টি, যাদের প্রায় সব কটিই সুন্দরবনে বিচরণ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের এই বেঙ্গল টাইগার প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে বিস্তৃত এই বনেই এদের চলাফেরা। বাঘ সংরক্ষণে বন বিভাগ ও বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের উদ্যোগে নজরদারি, ক্যামেরা ট্র্যাপ, গ্রামভিত্তিক টহল ও সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে।

মিয়ানমার

বিশাল বনভূমির দেশ মিয়ানমারে রয়েছে মাত্র ২২টি বাঘ। তারা মূলত হুকাউং উপত্যকা, হটমানথি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ও তেনাসেরিম বনাঞ্চলে বিচরণ করে। দীর্ঘদিন ধরে সামরিক সংকট, বন ধ্বংস ও পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে দেশটিতে বাঘ সংরক্ষণ দুরূহ হয়ে পড়েছে।

চীন

মিয়ানমারের থেকে দুটি কম বাঘ নিয়ে দশম স্থানে রয়েছে চীন। তারা মূলত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জিলিন ও হেইলংজিয়াং প্রদেশের সীমান্ত এলাকায় ‘নর্থইস্ট চায়না টাইগার অ্যান্ড লেপার্ড ন্যাশনাল পার্কে’ থাকে। চীনে সংরক্ষণের ব্যবস্থা উন্নত হলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ সীমিত হওয়ায় বাঘের তেমন একটা বংশবৃদ্ধি হয়নি।