
ভারতের বিহার রাজ্যের বিধানসভা ভোটের মনোনয়নপত্র জমা পড়ার আগপর্যন্ত সবার নজর ছিল যেখানে, হঠাৎই তা ঘুরে গেছে। এই মুহূর্তে সবার দৃষ্টি কাড়ছেন একজনই। বিহার রাজনীতির একমেবাদ্বিতীয়ম চাণক্য তিনিই। গত দুই দশক ধরে তিনিই রাজ্য রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। তিনি নীতীশ কুমার।
জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরে উঠে আসা চুয়াত্তর বছরের এই সমাজতন্ত্রী নেতা গত কুড়ি বছরে নয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। ইচ্ছেমতো শিবির বদল করেছেন। নিজেই নির্ধারণ করেছেন কাদের সঙ্গী করে রাজ্য শাসন করবেন। মাঝে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে জিতনরাম মাঞ্ঝিকে বসিয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন। ছেড়ে দেওয়া আসন আবার কেড়ে নিয়ে রাজ্যের দণ্ডমুন্ডের কর্তা হয়েছেন।
এবার নীতিশ বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে লড়ছেন ঠিকই। কিন্তু কেউ জানে না, গণনা শেষে কোন খেলা তিনি দেখাবেন। নীতীশই সেই আশ্চর্য মানুষ এখনো, যাঁর মনের হদিস কেউ পায়নি। বিহারি রাজনীতিতে যাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ঘোর অনিশ্চয়তার একটা বলয়।
হঠাৎই তাঁর দিকে নজর ঘুরে যাওয়ার কারণ বিজেপির সর্বগ্রাসী রাজনীতি। হিন্দি বলয়ে বিহারই একমাত্র রাজ্য, যেখানে নিজের ক্ষমতায় বিজেপি কখনো রাজত্ব করতে পারেনি। যেখানে এখনো বিজেপির কেউ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। টানা ৩৫ বছর ধরে বিহারের রাজনীতি শাসন করেছেন লালু প্রসাদ ও নীতীশ কুমার। ১৫ বছর শাসনের পর লালু প্রসাদ অস্তমিত।
২০ বছর ধরে নীতীশ বিহারকে তালুবন্ধ করে রেখেছেন। এনডিএ জোটের বড় শরিক হয়েও বিজেপি বাধ্য হয়েছে নীতীশের নেতৃত্বে সরকারে থাকতে। এই প্রথম তারা স্বপ্ন দেখছে এক নম্বর দল হিসেবে ক্ষমতা ধরে রেখে নিজেদের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করবে। তাদের সেই অভিপ্রায় এখন আর মোটেই গোপন নয়।
নীতীশের নেতৃত্বে ভোট অভিযানের কথা বললেও নরেন্দ্র মোদি অথবা অমিত শাহ একবারের জন্যও এখনো জানাননি, এনডিএ জিতলে নীতিশই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। আর এ কারণেই এখন সবার নজর ঘুরে গেছে নীতীশের দিকে।
শুরু হয়েছে জল্পনা, রাজনৈতিক জীবনের উপান্তে এসে নীতীশ কি তাহলে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে গিয়ে বিজেপির হাতে তুলে দিয়ে যাবেন রাজ্য শাসনের ভার? নাকি শেষ বেলায় ভোল বদলে শিবির বদল করে নিজের প্রাসঙ্গিকতা আরেকবার প্রমাণ করবেন? তারপর ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর মতো সরে যাবেন নিজের ইচ্ছায় নিজের বেছে নেওয়া সময়ে?
অথচ পাদপ্রদীপের আলোয় এত দিন পর্যন্ত ছিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর, ‘পিকে’ নামে যিনি আসমুদ্র হিমাচলে পরিচিত। বিজেপির নরেন্দ্র মোদি, কংগ্রেসের অমরিন্দর সিং (পাঞ্জাব), অন্ধ্র প্রদেশের জগনমোহন রেড্ডি (ওয়াইএসআর কংগ্রেস), আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ডিএমকের এম কে স্ট্যালিন ও পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের ক্ষমতাসীন করার পেছনে তাঁর হাতযশ সর্বজনস্বীকৃত। এতকাল যিনি ছিলেন ‘কিংমেকার’, তিনি এবার রাজা হওয়ার বাসনায় গত তিন বছর ধরে বিহার চষে বেরিয়েছেন। দল গড়ে রাজ্য শাসনের খোয়াব দেখছেন।
প্রশান্তের এই বাসনা কোন দল বা কোন জোটকে ডুবিয়ে কাকে ভাসাবে, এই নিয়ে এত দিন ধরে চলেছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পিকেই টেনে নিয়েছিলেন প্রচারের সব আলো তাঁর মুখে। অথচ এখন, প্রচার যখন তুঙ্গে, তখন হঠাৎই সব আলো টেনে নিয়েছেন নীতীশ কুমার। তাঁকে ঘিরে শুরু হয়েছে সব জল্পনা। আর, সেই জল্পনার সুযোগ করে দিয়েছে বিজেপির সিদ্ধান্তহীনতা। নীতীশকে আগাম মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা না করার মাশুল বিজেপিকে দিতে হবে কি না, শুরু হয়েছে সেই কানাকানি।
এই জল্পনার ধোঁয়ায় ধুনো জুগিয়েছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। ধোঁয়াশা সেখানেও ছিল। টানাপোড়েনও কম ছিল না। আসন ভাগাভাগি নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আরজেডির মনোমালিন্য জোটের সাফল্যের ওপর ছায়াও ফেলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস সবাইকে পাশে নিয়ে ঘটা করে জানিয়ে দেয়, মহাজোট (ইন্ডিয়া) জিতলে তেজস্বী যাদবই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। উপমুখ্যমন্ত্রী হবেন চরম অনগ্রসর শ্রেণির নেতা বিকাশশীল ইনসান পার্টির মুকেশ সাহনি।
শুধু ওই ঘোষণাই নয়, সেই মঞ্চ থেকেই কংগ্রেস ও আরজেডি নেতারা চ্যালেঞ্জ জানান বিজেপিকে। তেজস্বী বলেন, বিজেপিও জানিয়ে দিক, এনডিএ জিতলে কে হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। নীতীশ কুমারকেই তারা আবার দায়িত্বে রাখবে কি না। তিন দিন কেটে গেলেও বিজেপি তা করেনি।
গতকাল শুক্রবার বিহারে দুটি জনসভা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নীতীশের দল জেডিইউয়ের সবাই মুখিয়ে ছিলেন, মোদি হয়তো তা জানিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি শুধু বললেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে এনডিএ জোট এবার রেকর্ড আসনে জিতবে।’ জিতলে নীতীশই যে ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা জানালেন না। ফলে নীতীশের ভবিষ্যৎ ঘিরে ধোঁয়াশা থেকেই গেল।
বিজেপির পরিকল্পনা নিয়ে জেডিইউয়ের সন্দেহ করার কারণও আছে। ২০২১ সালে আসামে বিজেপি লড়েছিল মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেতৃত্বে। জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী করা হয় হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে। ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশে বিজেপি লড়েছিল কেশবপ্রসাদ মৌর্যের নেতৃত্বে। মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল যোগী আদিত্যনাথকে। ২০২৪ সালে মহারাষ্ট্রে জোটবদ্ধ বিজেপি লড়েছিল শিবসেনার একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বে। তিনিও ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী হন বিজেপির দেবেন্দ্র ফডনবিশ। শিন্ডেকে হতে হয় উপমুখ্যমন্ত্রী।
বিহারে এত দিন জেডিইউ বেশি আসনে লড়ত। এই প্রথম বিজেপি ও জেডিইউ দুই দলই লড়ছে ১০১টি করে আসনে। গত ভোটে যাকে দিয়ে জেডিইউয়ের ভোট কাটিয়েছিল বিজেপি, সেই চিরাগ পাসোয়ানকে এবার বিজেপি দিয়েছে ২৯টি আসন।
নীতীশও বুঝে গেছেন, বিহারে বিজেপি তাদের হাল করতে চাইছে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার মতো। তাঁর সাহায্য নিয়ে ক্ষমতায় এসে তাঁকে সরিয়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাতে চায় তাদেরই কোনো নেতাকে। অমিত শাহ সংবাদ সম্মেলনেও সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, জয়ী বিধায়কেরাই ঠিক করবেন মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন। নির্বাচনী প্রচারে মোদি–শাহও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নীতীশের নাম নিলেন না। অতএব ছকটা পাকা। অপেক্ষা শুধু ফল প্রকাশের।
ফলে রাজনৈতিক জল্পনা এখন একটাই। কী করবেন নীতীশ? বিজেপির স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হবেন? নাকি শেষ বেলায় ওস্তাদের মতো জেগে উঠবেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত সবাই। রাজ্যে বিজেপিকে ক্ষমতায় না আনতে বদ্ধপরিকর লালু প্রসাদ বলে দিয়েছেন, মহাজোটের দরজা খোলা রয়েছে। একদা নীতীশের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বীও বলেছেন, চাচার (নীতীশ) হাতে জোটের রাশ আর নেই। তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করছেন মোদি–শাহ। জিতলে তাঁদেরই কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে।
পিকে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন না। তাঁর প্রার্থীদের ‘ভয় দেখিয়ে’ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করাচ্ছেন অমিত শাহ। এই অভিযোগ তিনি নিজেই করেছেন। ভোট কাটুয়া হয়ে পিকে কার সুবিধে করে দেবেন, সেই সম্ভাবনার দিকে না তাকিয়ে বিহারি জনতা দৃষ্টি ঘুরিয়েছে কিছুটা অশক্ত হয়ে পড়া নীতীশ পানে।
বারবার শিবির পাল্টে যিনি ‘পলটু রাম’ বলে পরিচিতি পেয়েছেন, আরেকবার রাজনীতিক নীতীশ যে তা করবেন না, সেই বাজি কেউ ধরতে নারাজ। বিহারে সব আগ্রহ এখন নীতীশকে ঘিরেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গমগম করছে। মোদি ও বিজেপিকে ঠেকানোর তুরুপের তাস নীতীশ কখন ফেলেন, শুরু হয়েছে সেই দমবন্ধ প্রতীক্ষা।