
তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরুপ্পুর ভারতের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি অঞ্চল। সেখানে এন কৃষ্ণমূর্তির তৈরি পোশাক কারখানায় অদ্ভুত এক নীরবতা বিরাজ করছে।
কারখানার একটি ফ্লোরে প্রায় ২০০টি শিল্প সেলাই মেশিনের কেবল কয়েকটিতে সেলাই কাজ চলছে। শ্রমিকেরা মৌসুমের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি থেকে অর্ডার পাওয়া শিশুদের পোশাক তৈরি করছেন।
কক্ষের এক কোনায় নতুন নকশার কাপড়ের নমুনা স্তূপ করে রাখা, সেগুলোর ওপর ধুলা জমছে। কাপড়ের নমুনা ওই স্তূপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা ৫০ শতাংশ শুল্কের শিকার। ভারতের ওপর ট্রাম্পের আরোপ করা এই শুল্ক আগামীকাল বুধবার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিকারক বড় বড় দেশগুলোর একটি ভারত। এশিয়ার এই দেশ থেকে তৈরি পোশাক, চিংড়ি, বিভিন্ন রত্নপাথর ও গয়না যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।
অন্তর্বাস তৈরির অন্য একটি কারখানায় বিবিসির প্রতিনিধিরা প্রায় ১০ লাখ ডলারের মালামাল পড়ে থাকতে দেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টোরের জন্য সেগুলো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেগুলো পড়ে আছে, কেউ নিতে চাইছেন না।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই উচ্চ শুল্ক আরোপ ভারতীয় পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো প্রভাব ফেলছে। ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপসহ রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র কেনার কারণে দেশটির ওপর শাস্তিমূলক আরও অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মোট শুল্ক ৫০ শতাংশ। এর ফলে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য খাতে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বাণিজ্য নিয়ে অনিশ্চিত এই পরিস্থিতি দেশটির ব্যবসার মালিক ও কর্মীদের ওপর কীভাবে এবং কতটা প্রভাব ফেলছে, তা দেখতে বিবিসির প্রতিনিধিরা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রপ্তানি অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন।
ভারতের ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এক-তৃতীয়াংশ অবদান তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর রপ্তানি অঞ্চলের। ওয়ালমার্ট, গ্যাপ ও জারার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি হয় এখানে। কিন্তু নতুন শুল্কের কারণে পুরো তিরুপ্পুর রপ্তানি অঞ্চলজুড়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে তীব্র উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
কৃষ্ণমূর্তি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর থেকে হয়তো আর কিছু করার থাকবে না।’ তিনি বলেন, তাঁর যেসব গ্রাহক আছেন, তাঁরা সবাই নিজেদের অর্ডার স্থগিত করেছেন।
সেপ্টেম্বর থেকে হয়তো আর কিছু করার থাকবে না।....এন কৃষ্ণমূর্তি, ভারতীয় গার্মেন্টসমালিক
অথচ, কৃষ্ণমূর্তি তাঁর কারখানা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেছিলেন, এ জন্য প্রায় ২৫০ নতুন কর্মী নিয়োগও দিয়েছিলেন। এখন তাঁকে সব পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের আগে এই ব্যবসায়ী নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছিলেন, এখন সে নিয়োগও স্থগিত।
যে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুল্ক আরোপের ঘোষণা এসেছে, সেটা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। কারণ, বেশির ভাগ রপ্তানি বাণিজ্যের মোট বার্ষিক বিক্রির প্রায় অর্ধেকই হয় এই সময়ে, ডিসেম্বরের শেষ দিকে বড়দিন ও নববর্ষের উৎসবকে সামনে রেখে।
এখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলো নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে দেশি বাজার এবং ভারতের আসন্ন দীপাবলি মৌসুমের ওপর নির্ভর করছে।
অন্তর্বাস তৈরির অন্য একটি কারখানায় বিবিসির প্রতিনিধিরা প্রায় ১০ লাখ ডলারের মালামাল পড়ে থাকতে দেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টোরের জন্য সেগুলো তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু এখন সেগুলো পড়ে আছে, কেউ নিতে চাইছেন না।
র্যাফট গার্মেন্টসের মালিক শিভ সুব্রামানিয়াম বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা আশা করছিলাম, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করবে। গত মাসে পুরো উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। যদি এভাবে চলতে থাকে, আমি শ্রমিকদের কীভাবে বেতন দেব?’
৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকরের পর ভারতের তৈরি একটি শার্ট কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ১৬ দশমিক ৪ ডলার খরচ করতে হবে, আগে যে শার্ট ১০ ডলারে পাওয়া যেত। ক্রেতারা একই মানের শার্ট চীন থেকে ১৪ দশমিক ২ ডলারে, বাংলাদেশ থেকে ১৩ দশমিক ২ ডলারে অথবা ভিয়েতনাম থেকে ১২ ডলারে তাঁরা কিনতে পারবেন।
৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকরের পর ভারতের তৈরি একটি শার্ট কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ১৬ দশমিক ৪ ডলার খরচ করতে হবে, আগে যে শার্ট ১০ ডলারে পাওয়া যেত। ক্রেতারা একই মানের শার্ট চীন থেকে ১৪ দশমিক ২ ডলারে, বাংলাদেশ থেকে ১৩ দশমিক ২ ডলারে অথবা ভিয়েতনাম থেকে ১২ ডলারে তাঁরা কিনতে পারবেন।
যদি শুল্ক ২৫ শতাংশ কমানোও হয়, ভারত তখনো এশিয়ার সমকক্ষদের তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে।
শুল্ক আরোপের প্রভাব কিছুটা কমাতে ভারত সরকার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। যেমন কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক স্থগিত। বাজারে বৈচিত্র্য আনতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনাও ত্বরান্বিত হয়েছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, এসব উদ্যোগ অতি সামান্য, অনেক দেরিও হয়ে গেছে।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘আমরা বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আসা প্রত্যাশা করতে পারি, যেখানে মার্কিন ক্রেতারা মেক্সিকো, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে চলে যাবে।’
তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে মুম্বাইয়ের একটি রপ্তানি অঞ্চলে শত শত শ্রমিক হীরার পলিশ এবং মোড়কজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এই রপ্তানি অঞ্চলটি ভারতের এক হাজার কোটি ডলারের রত্ন ও গয়না রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কিন্তু এখানে গয়নার ব্র্যান্ডগুলো সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তাদের বিক্রির ওপর শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। এখান থেকে প্রায় ৩০০ বা ৪০০ কোটি ডলারের গয়না যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।
এই শুল্ক কে সহ্য করতে পারবে? এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতারাও তা করতে পারবেন না।... আদিল কোটওয়াল, হীরা ব্যবসায়ী
যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য অংশীদারত্ব নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু বহু বছরের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের যে অবস্থান তারা গড়ে তুলেছে, তা কয়েক মাসের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ক্রিয়েশন জুয়েলারির আদিল কোটওয়াল। তিনি তাঁর কারখানায় তৈরি হীরাখচিত গয়নার ৯০ শতাংশ মার্কিন বাজারে বিক্রি করেন।
আদিল মাত্র ৩ বা ৪ শতাংশ মুনাফা রাখেন। তাই অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কও তাঁর জন্য টিকে থাকা কঠিন করে তোলে। আদিল বিবিসিকে বলেন, ‘এই শুল্ক কে সহ্য করতে পারবে? এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতারাও তা করতে পারবেন না।’
প্রতিবেশী গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহর থেকে গয়না তৈরির জন্য পাথর সংগ্রহ করেন আদিল।
বিশ্বের বৃহৎ হীরা কাটাই ও পলিশ কেন্দ্রগুলোর একটি সুরাটে অবস্থিত।
বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস এবং গবেষণাগারে উৎপাদিত হীরার সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে শুল্ক আরোপের আগেই এই খাতের অস্তিত্ব রক্ষার সংকট তৈরি হচ্ছিল। নতুন শুল্ক তাদের জন্য দ্বিগুণ আঘাত হয়ে এসেছে।
বাজার থেকে মার্কিন ক্রেতারা এখন উধাও হয়ে গেছেন। এসব কারখানায় কাজ করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন সেগুলোতে মাসে মাত্র ১৫ দিন কাজ চলে। আর শত শত চুক্তিভিত্তিক শ্রমিককে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ। আর এ খাতে দেশটির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র।
শহরের উপকণ্ঠে একটি হীরা পলিশ কারখানার ভেতর ম্লান আলো জ্বলছে। সারি সারি ধুলোমাখা অব্যবহৃত টেবিল সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
একজন শ্রমিক বলেন, ‘একসময় জায়গাটা সরগরম থাকত। সম্প্রতি অনেক মানুষের চাকরি চলে গেছে। আমাদের কী হবে, তা জানি না।’
এই কারখানাটির মালিক শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া। তিনি বলেন, একসময় তাঁর ৩০০ শ্রমিক ছিল। এখন মাত্র ৭০ জন আছেন। আগে প্রতি মাসে পলিশ করা হীরার সংখ্যা দুই হাজার ছিল, সেখান থেকে নামতে নামতে এখন ৩০০-এ পৌঁছেছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারগুলোর ওপর নির্ভর করছে।.....গোপাল নাদুর, পরামর্শ সংস্থা এশিয়া গ্রুপ
স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ভাভেশ ট্যাঙ্ক বলেন, এখানে শ্রমিকদের মজুরি কমে গেছে, জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে এবং মাসিক আয় হ্রাস পেয়েছে।
ভারতের অনেক চিংড়িচাষি এই ধাক্কায় টিকে থাকতে অন্য পণ্য উৎপাদনে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ। আর এ খাতে দেশটির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যান্য শুল্কসহ, চিংড়ির ওপর মোট শুল্ক এখন ৬০ শতাংশের ওপরে চলে যেতে পারে। এই খাতের জন্য এটি একটি মারাত্মক ধাক্কা। কারণ, প্রথমবার শুল্ক ঘোষণার পর থেকে প্রতি কেজিতে দাম ০ দশমিক ৬০ থেকে ০ দশমিক ৭২ ডলার কমে গেছে। ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে দাম আরও কমে যেতে পারে।
চিংড়ি রপ্তানিকারক টোটা জগদীশ বিবিসিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের জন্য বড়দিন ও নববর্ষকে সামনে রেখে পণ্য কেনার এখনই সেরা সময় (পিক সিজন)। সে লক্ষ্যে এখানে চিংড়িচাষিরা কেবল তাঁদের চিংড়ি উৎপাদনের নতুন চক্র শুরু করেছেন। ট্রাম্পের শুল্ক এখানে বড় ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।’
হ্যাচারির মালিকেরা বলছেন, শুল্কের কারণে তাঁরা চিংড়ির লার্ভা উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছেন।
প্রায় পাঁচ লাখ চিংড়িচাষির জীবিকায় এর সরাসরি আঘাত লাগতে পারে। আর অপ্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হতে পারে আরও ২৫ লাখ চাষি।
ভারত আগে থেকেই যেখানে কর্মসংস্থানের সংকটে জর্জরিত। সেখানে নতুন শুল্ক বেকারের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কে স্থবিরতা অব্যাহত আছে। বরং গত কয়েক সপ্তাহে বাণিজ্য আলোচনা চালানোর পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে।
পরামর্শ সংস্থা এশিয়া গ্রুপের গোপাল নাদুর বিবিসিকে বলেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারগুলোর ওপর নির্ভর করছে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছাড়াও এখানে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী নেতাদের পরামর্শ দিতে গিয়ে গোপাল আরও বলেন, তাঁদের এখন আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানো, বাজারে বৈচিত্র্য আনা এবং কোনো সুযোগ হাতছাড়া না করার মূলনীতিতে চলে যেতে হবে।