গণপিটুনি
গণপিটুনি

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয়

ভারতে বাড়ছে গণপিটুনি, পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই

অচেনা বা বিদেশি মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা ও ভয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ভারতেও বাড়ছে। বিদ্বেষমূলক মনোভাবের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক সময় আগন্তুকদের প্রতি সহিংস হয়ে ওঠেন। ঘটে গণপিটুনির মতো ঘটনা। ভারতে বিজেপির টানা তৃতীয় মেয়াদের শাসনে সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ বেড়েছে। তারপরও সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। চলতি মাসে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিদেশি সন্দেহে অন্তত তিনজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এই ভয়ংকর প্রবণতা নিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া গতকাল রোববার একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।

ভিন্ন একটি দিন, ভিন্ন একটি রাজ্য, ভিন্ন একটি রোমহর্ষক গণপিটুনির ঘটনা। চলতি মাসে এটি নিয়ে এ রকম তিনটি ঘটনা ঘটল। তাই বলতে হয়, লজ্জা ও আতঙ্কজনক একটি পাদটীকা নিয়ে বছরটি বিদায় নিচ্ছে। এমন একটি বছর শেষ হতে চলেছে, যেখানে আমরা ‘অপর করে দেওয়া’ (আদারিং) ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে দেখছি। প্রশ্ন উঠেছে—তরুণ ও কর্মজীবী মানুষ কি নিজ দেশে নির্ভয়ে-নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবেন না?

উত্তরাখন্ডের একদল মানুষ সম্প্রতি দেরাদুনে এক তরুণকে ছুরিকাঘাত করে। ২৪ বছর বয়সী ভুক্তভোগী তরুণ এমবিএ শিক্ষার্থী ছিলেন। এক বছর ধরে তিনি ওই শহরে থাকছিলেন। তাঁকে নিয়ে বর্ণবিদ্বেষী কটূক্তি করা হলেও তিনি শান্ত ছিলেন। তা সত্ত্বেও হামলাকারীরা তাঁকে ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান।

চলতি মাসে আরও দুজন পরিযায়ী শ্রমিক গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। একজন ওডিশায়। তাঁর বয়স ১৯-২০ বছর। আরেকজন কেরালা রাজ্যের ছত্তিশগড়ে। তাঁর বয়স ৩১ বছর। তাঁরা উভয়ে বাঙালি। তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশি ছিলেন না। এ দুই ঘটনা সারা দেশে প্রান্তিক পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তাঝুঁকি বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আফ্রিকা ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও শ্রমিকেরা কয়েক দশক ধরে দিল্লিসহ উত্তর ভারতের নানা রাজ্যে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সরকার বর্ণবাদ বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। উল্টো বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি এবং চরম সহিংসতাকে পুলিশ প্রায় সময় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দায় সারে, যা আদতে বিচ্ছিন্ন নয়। এই বর্ণবাদ ও ‘আদারিং’–এর সুস্পষ্ট ধরন আছে। তারপরও এসবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না থাকায়, এসব ঘটনা এখন ঘন ঘন ঘটছে এবং নগ্ন-সহিংস রূপ নিচ্ছে।

ভারতীয় শিক্ষার্থীরাও বিদেশে, বিশেষ করে ট্রাম্পের আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন। ভারতের সুবিধাভোগী ও উচ্চবিত্তরা পশ্চিমা দেশে নিজেদের ‘অ-শ্বেতাঙ্গ’ হিসেবে চিহ্নিত হতে দেখে এবং সেসব দেশে যেসব জনগোষ্ঠীর মানুষের দিকে অনেক সময় তাচ্ছিল্যভরে তাকানো হয়, সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের এক কাতারে দেখে হতভম্ব হয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁরা এখন ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (এমএজিএ—যা মাগা নামে পরিচিত) প্রচারের ধাঁচে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আদারিংয়ের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু অন্য দেশে ভুক্তভোগী হলেও নিজ সমাজে বিদ্যমান বর্ণবাদী মনোভাব নিয়ে আমরা চুপ।

সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফোর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া বা নীতি আয়োগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এক লাখ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু বর্ণ ও গায়ের রঙের প্রশ্নে বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা না গেলে, তা সম্ভব হবে না। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, তাঁরা নিজ দেশে আদারিংয়ের শিকার হচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, এটা বৃদ্ধি হতে দিলে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া অনিবার্য।

আদারিং দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করলেও বছরের পর বছর ধরে সরকার বিষয়টির প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপপ্রচার ও ভুয়া খবর বা বাস্তব জীবনে বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। দেখা গেছে, অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যায়। পুলিশ ও সরকার ঘটনা ঘটার পরই কেবল প্রতিক্রিয়া দেখায়।

বেশ কয়েক বছর আগে গুজব রটেছিল—‘শহরে অপহরণকারীরা’ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। তখন পুলিশের কঠোর মনোভাবের কারণে মিথ্যা প্রচার নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। রাজনৈতিকভাবে অস্থির পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও কেরালার বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’–বিষয়ক জুজু অসহিষ্ণুতাকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আদারিং একধরনের পদ্ধতিগত বিষ। এর বিস্তার রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে সরকারকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক নাগরিককে একে অপরের কাছ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে।