নরেন্দ্র মোদি ও গৌতম আদানি
নরেন্দ্র মোদি ও গৌতম আদানি

আদানিকে বাঁচাতে ৩৯০ কোটি ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা মোদি সরকারের

চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির ব্যবসায় ঋণের চাপ দ্রুত বাড়ছিল। ভারতের এই অন্যতম শীর্ষ ধনীকে তখন একে একে পুরোনো দেনা শোধ করতে হচ্ছিল।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ঘুষ ও জালিয়াতির মামলায় অভিযুক্ত হন ভারতের এই ধনী ব্যবসায়ী। প্রায় ৯০ বিলিয়ন বা ৯ হাজার কোটি ডলারের মালিক হলেও আমেরিকা ও ইউরোপের বড় ব্যাংকগুলো তাঁকে ঋণ দিতে গড়িমসি করছিল। ঠিক সেই সময় নীরবে এগিয়ে আসে ভারত সরকার। ২৪ অক্টোবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর অনলাইন সংস্করণে এই খবর প্রকাশিত হয়।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর হাতে থাকা গোপন সরকারি নথি বলছে, মে মাসে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (ডিএফএস) রাষ্ট্রায়ত্ত লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এলআইসি) মাধ্যমে গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপে প্রায় ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৩৯০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। যদিও এলআইসি মূলত দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জীবনবিমা সেবা দেয়।

একই মাসে আদানির বন্দর ইউনিটের ৫৮৫ মিলিয়ন বা ৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ পুনঃ অর্থায়নের প্রয়োজন ছিল। সমপরিমাণ অর্থের জন্য একটি বন্ড ছাড়ে আদানি গ্রুপ। পরে জানা যায়, পুরো বন্ডে এককভাবে অর্থায়ন করে এলআইসি। সমালোচকেরা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন—এটা কি জনগণের অর্থের অপব্যবহার নয়?

ভারতের করপোরেট খাতের অর্থায়নবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক হেমেন্দ্র হাজারি বলেন, এই সরকার আদানিকে রক্ষা করবে, তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।

নথি ও সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, এটি ছিল সরকারের বড় পরিকল্পনার অংশ। এর মধ্য দিয়ে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে অর্থ সরবরাহ করে সরকার। ভারতের করপোরেট খাতের অর্থায়নবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক হেমেন্দ্র হাজারি বলেন, এই সরকার আদানিকে রক্ষা করবে, তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।

সরকারি প্রণোদনা নয়, দাবি আদানির

আদানি গ্রুপ অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, এলআইসি অনেক কোম্পানিতেই বিনিয়োগ করে, কেবল আদানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে—এ ধারণা বিভ্রান্তিকর। এমনকি এলআইসি আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করে মুনাফাও করেছে। তারা আরও জানায়, ‘আমাদের প্রবৃদ্ধি মোদি সরকারের আগেই শুরু হয়েছে।’ তবে ভারতের সরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগ এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টকে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

নথিতে দেখা যায়, নীতি আয়োগ, এলআইসি ও ডিএফএস মিলে এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করে। পরবর্তীকালে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়।

ডিএফএসের ভাষায়, এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল আদানি গ্রুপের প্রতি আবার বাজারের আস্থা তৈরিতে সহায়তা করা এবং অন্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। তখন আদানি গ্রুপের অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। তাদের মোট ঋণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে মামলা, দেশে প্রশ্রয়

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ আদানির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণের অভিযোগ আনে। একই দিনে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (এসইসি) আদানির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইনভঙ্গের মামলা করে। আদানি গ্রুপ পাল্টা জানায়, এসব অভিযোগ ‘ব্যক্তির বিরুদ্ধে’; এই গোষ্ঠীর কোম্পানির সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

ডিএফএসের ভাষায়, এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল আদানি গ্রুপের প্রতি আবার বাজারের আস্থা তৈরিতে সহায়তা করা এবং অন্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। তখন আদানি গ্রুপের অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। তাদের মোট ঋণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ার কারচুপি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলে। এ ঘটনার সূত্রে ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) তদন্ত শুরু করে। আদানির বিরুদ্ধে করা হিন্ডেনবার্গের দুটি অভিযোগ সেবি খারিজ করলেও এখনো কিছু বিষয় অমীমাংসিত আছে।

এলআইসি দরিদ্র মানুষের জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ তাদের মূল লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থী। তারা প্রকৃতই স্বাধীন সংস্থা হলে এই সিদ্ধান্ত নিত না
কুশ আমিন, আইনবিশেষজ্ঞ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ঝুঁকি

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় এলআইসিকে প্রায় ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৩৪০ কোটি ডলার মূল্যের আদানির করপোরেট বন্ডে বিনিয়োগ এবং আরও ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যয়ে কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অংশীদারত্ব বাড়ানোর সুপারিশ করে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সরকারি ১০ বছরের বন্ড থেকে আয় ছিল তুলনামূলক কম। তবে আদানির কোন কোন কোম্পানিতে এলআইসির অংশীদারি বেড়েছে, তা পরিষ্কার নয়।

আদানি গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কাঠামো নিয়ে কাজ করেন অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলি। তিনি বলেন, ভারত সরকারের সমর্থন থেকে বোঝা যায়, আদানি ‘ভিন্ন নিয়মে’ ব্যবসা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। বাকলি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কাজ আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্বজনতোষণনির্ভর পুঁজিবাদ এখনো বেঁচে আছে এবং দারুণভাবে তা চলছে।’

বন্ধুত্বের মূলধন

আদানির ব্যবসার শিকড় ভারতের গুজরাটে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক উত্থানও সেখানেই। ১৯৯১ সালে গুজরাটের মুন্দ্রায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার পর থেকেই মোদি-আদানির সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় আদানি গ্রুপের বিমান ব্যবহার করেন মোদি। মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির সখ্য নিয়ে ভারতের বিরোধী রাজনীতিকেরাও সব সময় সরব।

আমার মনে হয়, ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কাজ আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্বজনতোষণনির্ভর পুঁজিবাদ এখনো বেঁচে আছে এবং দারুণভাবে তা চলছে।
অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলি

গৌতম আদানি আজ ভারতের অর্থনীতির প্রতিটি শাখায় জড়িয়ে আছেন। যেমন দেশটির মোট পণ্য পরিবহনের ২৭ শতাংশ আদানির বন্দরের মাধ্যমে হয়; বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তিনি সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগকারী; এমনকি ২০২২ সালে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন এনডিটিভি অধিগ্রহণ করেন তিনি। এমনকি ওই সময় তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনীতে পরিণত হন। তাঁর সামনে ছিলেন কেবল ইলন মাস্ক।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আইনবিশেষজ্ঞ কুশ আমিনের ভাষায়, এলআইসি দরিদ্র মানুষের জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ তাদের মূল লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থী। তারা প্রকৃতই স্বাধীন সংস্থা হলে এই সিদ্ধান্ত নিত না।