গত বছরের মার্চে ইসরায়েলি হামলায় আহত হওয়ার পর মাহমুদ আজুরকে গাজা থেকে কাতারে নিয়ে যাওয়া হয়
গত বছরের মার্চে ইসরায়েলি হামলায় আহত হওয়ার পর মাহমুদ আজুরকে গাজা থেকে কাতারে নিয়ে যাওয়া হয়

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বর্ষসেরা ছবি

আমি এভাবে কী করে বাঁচব, ড্রোন হামলায় দুই হাত হারানো গাজার শিশুর জিজ্ঞাসা

গাজায় গত বছর ইসরায়েলের এক ড্রোন হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয় ফিলিস্তিনি শিশুটি। তাকে নিয়ে তোলা একটি ছবি এ বছর (২০২৫ সাল) ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বর্ষসেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে। শিশুটি বলেছে, বিস্ফোরণে দুই হাত হারিয়ে এখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাকে।

আহত হওয়ার পর মাহমুদ আজুরকে কাতারের রাজধানী দোহায় নিয়ে যাওয়া হয়। আল–জাজিরার সঙ্গে এক আলাপে ৯ বছরের মাহমুদ তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে ২০২৪ সালে ইসরায়েলি ড্রোন হামলার ভয়ানক মুহূর্তের কথা স্মরণ করে। কাতারে তার চিকিৎসা চলছে।

গাজা সিটির পুরোনো একটি এলাকায় আজুরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আজুর বলেছে, (ওই বোমা বিস্ফোরণের মুহূর্তে) সে প্রাথমিকভাবে তার আহত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেনি।

আহত হওয়ার পর মাহমুদ আজুরকে কাতারের রাজধানী দোহায় নিয়ে যাওয়া হয়। আল–জাজিরার সঙ্গে এক আলাপে ৯ বছরের মাহমুদ তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে ২০২৪ সালে ইসরায়েলি ড্রোন হামলার ভয়ানক মুহূর্তের কথা স্মরণ করে। কাতারে তার চিকিৎসা চলছে।

আজুর বলেছে, ‘(প্রথমে) ভেবেছিলাম, আমি শুধু মাটিতে পড়ে গেছি। কিন্তু নিজেকে মাটিতে ক্লান্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। ভাবছিলাম, কী হয়েছে।’

আজুর বলে, ‘প্রকৃতপক্ষে, তখন আমার এক হাত উড়ে গেছে এবং আরেক হাত উড়ে গিয়ে আমার ডান পাশে এসে পড়ে।’

কাতারের দোহায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে পানি পান করছে মাহমুদ আজুর

আজুর যে গুরুতর আহত হয়েছে, সেটি এখনো সে বোঝে না। বিস্ফোরণে তার পুরো শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোমা হামলার পরও আজুর বুঝতে পারছিল না, আসলে কী হয়েছে। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল, তার দুই হাত মাটিতে পড়ে আছে। যদিও সেগুলো দেখে চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না যে তা তারই উড়ে যাওয়া হাত।

আজুরের মনে আছে, ‘আহত হওয়ার পর মা বলছিলেন, আমার দুই হাত হারিয়ে গেছে। শুনে আমি কাঁদতে শুরু করি, মনে খুব কষ্ট পাই। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।’

চিকিৎসাসামগ্রীর চরম সংকটের মধ্যে গাজার অনেকের মতো আজুরকেও অচেতন না করেই অস্ত্রোপচার করাতে হয়। এতে তার মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার সীমান্তগুলো অনেকটাই বন্ধ করে রেখেছে। ফলে ওষুধ, খাবার, ত্রাণ, জ্বালানিসহ জরুরি সহায়তা সেখানে ঢুকতে পারছে না।

ভেবেছিলাম, আমি শুধু পড়ে গেছি। কিন্তু নিজেকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম। খুবই ক্লান্ত। যা ঘটেছে, তা দেখে বিস্মিত হলাম। প্রকৃতপক্ষে, তখন আমার এক হাত উড়ে গেছে এবং আরেক হাত উড়ে গিয়ে আমার ডান পাশে এসে পড়ে।
মাহমুদ আজুর, ইসরায়েলি বোমায় আহত শিশু

আজুর বলেছে, ‘তাঁরা (চিকিৎসকেরা) আমাকে জাগিয়ে রেখেই আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করেছেন।’ ওই সময় আজুর যে কষ্ট পেয়েছে, তা তার কণ্ঠে এখনো ফুটে ওঠে।

‘আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না, খুব জোরে চিৎকার করছিলাম। চিৎকারে পুরো হাসপাতাল কেঁপে উঠছিল’, বলে আজুর।

‘সবকিছুই কঠিন’

আজুর গাজার হাজারও শিশুর একজন। এই শিশুরা ইসরায়েলের অব্যাহত ও নির্বিচার বোমাবর্ষণে জীবন পাল্টে দেওয়া পঙ্গুত্বের শিকার।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে দিনে গড়ে ১০টির বেশি শিশু তাদের এক বা দুই পা হারাচ্ছে। এ সংখ্যা এখন হাজারের বেশি।

দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে গতকাল শনিবার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের তাঁবুতে ইসরায়েলের হামলা

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বছরের ডিসেম্বরে বলেন, ‘বিশ্বে জনসংখ্যা অনুপাতে সবচেয়ে বেশি শিশু অঙ্গহানির শিকার এখন গাজায় এবং তাদের অনেককে অচেতন না করেই অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।’

আজুর এখন লেখা শিখছে। সে তার মুঠোফোনে গেম খেলে, পায়ের সাহায্য পোশাক পরে। কিন্তু নিত্যদিনের বেশির ভাগ কাজকর্মে অন্যের সহায়তা নিতে হয় তাকে। সে এখন সেসব দিনের কথা খুব মনে করে, যখন তার হাত অক্ষত ছিল।

আজুর যে গুরুতর আহত হয়েছে, সেটি এখনো সে বোঝে না। বিস্ফোরণে তার পুরো শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোমা হামলার পরও আজুর বুঝতে পারছিল না, আসলে কী হয়েছে। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল, তার দুই হাত মাটিতে পড়ে আছে। যদিও সেগুলো দেখে চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না যে তা তারই উড়ে যাওয়া হাত।

ইসরায়েলি হামলায় হাত হারানোর আগে সে বাজারে যেত এবং মায়ের জন্য শাকসবজি ও প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে আসত বলে জানায় আজুর।

সেই কথা স্মরণ করে আজুর বলে, ‘এখন সব কঠিন হয়ে গেছে—নিজে নিজে খাওয়া, শৌচাগারের কাজ সম্পন্ন করা, সবকিছুই। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এভাবেই আমি জীবন চালাই, নিজেকে সচল রাখি।’

আজুরের স্বপ্ন, ভবিষ্যতে সে নিজের ভূমি গাজায় ফিরতে ও বিধ্বস্ত এ উপত্যকা পুনর্গঠনে সহায়তা করতে পারবে।

আজুর আশা করে, এ বিশ্ব একদিন গাজায় যুদ্ধ থামাতে পারবে। সে বলে, ‘আমরা আমাদের ভূমিতে থাকতে চাই। ইসরায়েল এটি দখল করে নিক, তা আমরা চাই না।’

আহত হওয়ার পর মা বলছিলেন, আমার দুই হাত হারিয়ে গেছে। শুনে আমি কাঁদতে শুরু করি, মনে খুব কষ্ট পাই। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।
-মাহমুদ আজুর, ইসরায়েলি বোমায় আহত শিশু

ফিলিস্তিনি শিশুটির প্রশ্ন, ‘মানুষ সেখানে (গাজা) মারা যাচ্ছেন। আমাদের বাড়িতেও বোমা হামলা হয়েছে। আমি এভাবে বাঁচব কীভাবে?’

গাজা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৫১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগ শিশু ও নারী। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ১৬ হাজার ৫০৫ জন। এ তথ্য গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।

গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলীয় বেইত লাহিয়ায় খাবারের জন্য বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি শিশুদের অপেক্ষা

এ ছাড়া ইসরায়েলের নৃশংসতায় গাজা উপত্যকায় এক বা একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ২৩ লাখ বাসিন্দার অধিকাংশ। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশির ভাগ স্থাপনা ও মৌলিক অবকাঠামো। এ নৃশংসতা থেকে বাদ যায়নি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র।